(কাব্যগ্রন্থ- ‘এক ঋতু’, ‘সদর স্ট্রিটের বারান্দা’, ‘নিজস্ব ঘুড়ির প্রতি ’,
‘শুধু বিচ্ছিন্নতা নয় ‘, ‘মানুষের দিকে’,’অন্ধ প্রান ,জাগো’,
’নিঃশব্দ শিকড়’,’এখন একা নেই’, ‘বাধা পেরোনোর গান’,
’তিনটি কাব্য নাটিকা’, ‘হাওয়া ,স্পর্শ করো’.)
“একজন কবি যখন নিচু হয়ে জুতোর ফিতে বাঁধেন, তখনও তিনি কবি”।...হ্যাঁ, এমনই আপাদমস্তক কাব্যিক হিং ছড়ানো প্রণবেন্দুর হেঁশেল,জীবনকে গ্রাস করতে চেয়েও মানে খুঁজে না পাওয়া প্রণবেন্দু, শেষ পৃষ্ঠা খোলা রেখে প্রতিধ্বনির ভেতর প্রতিনিয়ত অচিহ্নিত এক নতুন প্রণবেন্দু; সে যেন অশ্বিনীতারার প্রণবেন্দু্ , একটি পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ের প্রনবেন্দু, এক তৃণসংঘ থেকে আরেক শ্যামলীর প্রণবেন্দু, তার সামনে যেন সমস্ত পৃথিবী পড়ে আছে অথচ কাউকে না চিনতে পেরে সর্বত্র্য এক পরম শূন্য হয়ে আছেন তিনি, এক ‘ নিঃস্ব স্তোত্রপাঠ’ । উঠোন পেরোনো মানুষ নিকটে এলেই যিনি বলেন মাঠ ছেড়ে আকাশে উঠে এসো,উঠে এসো হেমন্ত আঁধারে, কুয়াশা সরিয়ে আমি ঠিক খোঁজ নিয়ে যাব। চারদেওয়ালের কাঁচে প্রনবেন্দু সেই মেদহীন দর্শনার্থী ,যিনি জীবনের একটানা ক্ষয়েও খুঁজে চলেছেন সৃজনের সুধা, থাকার ভেতরে প্রবেশ করতে করতে প্রণবেন্দুর প্রিয় ঘরবাড়িউঠোণবারান্দাবৃষ্টিবাগানবাগিচাবেলোয়াড়ির আড়ালে কেবল চাপ চাপ কুয়াশা, যেন একা একা কিছু দূর গিয়ে ভারী হয়ে আছে পাখিটির ডানা, আর প্রজন্মের বেসক্যাম্প থেকে ,শূণ্যপ্রসব উদ্বাস্তুপল্লী থেকে বারবার হর্ষ ও বিষাদের মিশ্রিত আলেখ্যের অবস্থানটা খুঁজতে চেয়েছেন প্রণবেন্দু, বারবার আকুতি করেছেন পাখিটিকে যেন হাততালি দিয়ে উড়িয়ে না দেওয়া হয়; যেন ছাদের কার্ণিশে বসতে দেওয়া হয় তাকে, বিষন্ন মানুষ- একলা মানুষ- দুঃখ পেয়ে বেঁকে যাওয়া মানুষের স্নায়ু ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে দেওয়া হয় । সেই তো একা একা মানুষের প্রতিনিধি, সেই তো আকাশে ওড়ে অথচ মাটিতে পুঁতে রাখে তার প্রমান তার পাতানো বোন তার পাড়ার কানাকানি ;মানুষের মধ্যে থাকতে চেয়েছে প্রণবেন্দুর কবিতা, কম্যুনিকেট করতে চেয়েছে মানুষের বিশ্বাস বিকীর্ণতা বিস্তীর্ণতা, খুব আস্তে দূরে হেঁটে যেতে চেয়েছেন প্রণবেন্দু, হাঁক দিয়ে ফিরতে চেয়েছেন বাড়ি , অথচ একটা দৃশ্যের ভেতর কি নিরীহ এক দারুতামস,একটা কাঁচের ভেতর যেমন নির্বিকার ভাঙনের শব্দগুলো! খুঁদ কুড়ানো হাতে তিনি তুলতে চাইলেন অস্থিমজ্জাহীন মানুষের মস্ত মস্ত স্বাদ, এই তার সচেতন নির্মাণ । এই এক স্বপ্নবিক্রেতার অন্তিম মাধ্যাকর্ষণ; যেখানে ফেরিওয়াল ফুল নিয়ে আসে, দরাদরি করে আনন্দ নিয়ে, আর চারদেওয়ালের জ্যামিতিতে বুনে যায় চিত্রার্পিত যন্ত্রনা, চুনকামের গন্ধে যেখানে ঘুম ভাঙাতে আসে কেবল এক কুঁজো দার্শনিক; এই সেই জায়গা যেখানে দাঁড়িয়ে আশ্চর্য একাকীর স্মরনাপন্ন প্রণবেন্দু, এই সেই জায়গা যেখানে শুধু নিয়ম চলেছে, আর মানুষের পাশ থেকে সরে গেছে সঠিক মানুষী, যেখান থেকে সঠান ডাঙা বলে কিছু হয়না কেবল এক বিপরীত ডানা আর এই বিপরীত ডানায় ভর করেই রোদ এসে পড়ে প্রণবেন্দুর শরীরে, ভুঁই পিঁপড়ের মত উঠে আসে অ্যাক্সিওম্যাটিক ট্রুথ; ষাটের বা সত্তরের অচল অবরুদ্ধ নগরীর মাঝে সেই বেকার দুপুরগুলোকেই তিনি করলেন তার বিচরনক্ষেত্র, সদর স্ট্রিটের বারান্দা থেকে এক অসহায় কবিকে ঝেরে ফেলতে দেখা গেল পরিচয়গুলো, যেন এক আত্মপরিক্রমা যেখান থেকে থ্যাঁতলানো রোমান্টিজম হল্লা করে ওঠে, শীৎকার করে ওঠে-“কে বিরহ রেখে /ঐ নিবিড় মাঠের মধ্যে চলে গেছ/ আমরা সবাই আজ/ট্রামলাইনের পাশে/পানের দোকানে। শুধু/নিবিড়তাময় এক বৃষ্টি এসেছে। আর/তুমি চলে গেছ/ এই ভূতল উত্থিত কোনো ভালোবাসা /ছিল কি তোমার!!......নাকি এই গরীব পাড়ায় থেকে/শোক পেয়ে গেলে! ” এ কি সেই জীবনানন্দীয় ‘নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনা’ না কি সুধীন্দ্রীয় ‘নির্বিষাদ নির্বাণ’ ! আসলে সাধনভূত কোন হাশিস নয় বরং তৃষ্ণার ভেতর থেকেই উঠে আসে শাশ্বতযুগের সেই হিমসোঁতা পাখি, যাকে আলোর শহরে নিয়ে চলেছেন প্রনবেন্দু, নিয়ে চলেছেন অনিঃশেষ দুপুরে। এটা ওটা তুলে নিয়ে ঘর বাঁধবে বলে যারা আশ্চর্য ভাবে খুলে দিচ্ছে মহাকালের কুটিরশিল্প তারা জানছে না ‘দু দুটো দৌরিক পাখি হলুদ সবুজভাবে গাছে’ উড়ে চলেছে, ওরাই প্রণবেন্দুর ওরাই সেই চড়ূইভাতির রঙীন গল্পের মাঝে কবির খনিত মেঘের ছাঁট,যারা বুঝতে শিখছে –পাতা খসছে –পাতা খসছে-পাতা খসছে-
কোন ফেরার দিকে…..!
কোন অপরিচিতার সৌজন্যে……!
পূর্বপট
তখনও জানোনি দেয়ালের বাধা ছাড়িয়ে
কেউ যে জ্বালছে অন্যঘরের দেয়ালী,
সর্বনাশা যে, তার ত্রিললাট মাড়িয়ে
গোপনগঙ্গা প্রস্তরে খামখেয়ালী।
তুমি একবার বিস্মিত হয়ে তাকালে
দেখতে, কঠিন, ভ্রুযুগবিদ্ধ ধনুতে
সার্থকতমা উমার অঙ্গে, কাঁকালে
কুমার আসছে; ইঙ্গিত বরতনুতে ।।
একটি মৃত পাখি
পাখি মরে আছে,
পাখি বরফের স্তুপের ভেতরে মরে আছে ।
ছিল কি কোথাও আগে? বাসা বেঁধেছিল
পোড়ো জমিটির নীল গাছে?
নাকি হাওয়ার ফিকিরে, ঘুরে ফিরে,
এসে মরে গেল এই দুনম্বর বাড়ির শিবিরে ।
মাথা গুঁজে আছে,
যেন বরফের ভেতরের ঘর,
সিঁদ কাটতে চায়; যেন ব্যালেরিনা,
ভার পালটাতে গিয়ে আস্তে থেমে আছে-
ঘুরে গিয়ে, এক ঝাপটায়
আবার ভরাবে শূন্য শব্দময় রঙিন ডানায় ।
কিন্তু বড় দেরি হয়ে গেছে, মনে হয় ।
কিছু আগে ঈশ্বরের শেষ ক্ষমা করবার সাধ
মিটে গেছে। আজ শুধু শীতের আলোয়
ধবল নিঃসঙ্গ পাল
মেঘ-ছিন্ন, জলে পড়ে আছে,
পাখি মরে আছে,
পাখি শীতের ভেতরে মরে আছে ।।
অন্যভাবে নয়
কিছু হয়নি, কথার ভারে থেমে আছে,
দুলিয়ে দাও, তাকে কর দ্রাক্ষালতা,
তাকে ফোটাও অন্ধকারে আঁকাবাঁকা
মাঠের ওপর প্রতীক্ষিত সিসুগাছে-
কিছু হয়নি, আপাতত কিছু হয়নি।
ওরা ভীষন কথা বলে, ওরা কারা?
কিছু হয়নি, আকাশ-ভরা তারা জানে,
প্রেমিক দেখে প্রেমিকাটির ভীরু চোখে
ত্বরান্বিত , গাঢ় আয়না-
কিছু হয় না, অন্যভাবে কিছু হয় না ।।
আগামী নির্বাচন
কবিতা, কবিতা লেখা, কবিতার মধুর দালালি-
এখন কিছুই আর করতে পারি না।
বলতে পারি না ‘পাড়ার ছেলেকে
কিছু ভোট দিন,
এ-যাত্রা তরিয়ে দিন তরুন ভুবনে ।‘
স্মৃতি-বিস্মৃতির ফাঁকে দু একটি মানুষ
শুধু উঁকি দেয়। কিছু বা জোনাকি
জামরুল গাছের ঘর আলো করে থাকে।
সবারই স্বভাবচরিত্র খুব ভালো মনে হয়-
কারো কবিতা হবার দিকে
চেষ্টা দেখি না,
বলতে পারি না ; পাড়ার ছেলেটি এই
দাঁড়িয়ে রয়েছি
দিন, ভোট দিন, কিছু ভোট দিয়ে আমাকে বাঁচান।
কবিতা, কবিতা লেখা,কবিতার অমল দালালি-
এখন কিছুই আর করতে পারি না ।।
ভিতর বাহির
এক সময় সুতো ছিঁড়ে যায়-
আমরা তখন বিবস্ত্র , একাকী,
হাওয়া শুধু অন্য হাওয়া নাচায়,
চতুর্দিকে ফাঁকি।
বাহির তবু যথেষ্ট আশ্রয়
কখনো নয় বলে আবার ভেতর
নতুন করে তৈরি করতে হয়,
পোড়া-ইঁটের ঘর?
আমরা কিন্তু অন্যরকম চাই-
একটিবার চূড়ান্ত যাচাই
বাহির, এবং ভিতর ।।
এই মূর্হুতের কবিতা
কেউ আসে, কেউ আর ফিরেও আসে না।
কাঁটা বাবলার গাছে ফুল ফুটে আছে ।
একটা এরোপ্লেন শুধু একদৌড়ে মেঘ পার হল ।
তুমি কি তৈরি করতে পারবে এখুনি?
ভিতর-বাহির সব জড়ো করে শাঁখে ফুঁ দাও ।
খেলা শুরু করো ।
কেউ আসে, কেউ আর ফিরেও আসে না।
দ্যাখো, সমস্ত পৃথিবী পড়ে আছে ।।
মানুষ, ১৯৬১
ভাঙা ঘরে, মস্ত একটা হাওয়ায়,
মানুষ কাঁপছে;
একটা হাত পাশের মানুষীকে
ধরে আছে, আরেকটা হাত
কোথায় রাখবে-বুঝতে পারছে না,
পায়রা এসে বসেছে নিমগাছে।
সামনে শুধু রুদ্র এক পাহাড়
সামনে এক প্রচণ্ড ঝামরানো
সমুদ্রের ক্লান্ত অন্ধকার।
আড়াল করে দেখে নেবার মতো
কোথাও আর গোপন দৃশ্য নেই ;
মস্ত একটা হাওয়ায়, ভাঙাঘরে
মানুষ কাঁপছে ।।
তৃষ্ণার ভেতর থেকে
তৃষ্ণার ভেতর থেকে পাখি উঠে আসে।
হে ঝর্ণা আমার,
প্রতিটি শব্দকে তুমি সদ্যোজাত শিশুর মতন
দোলাও দুহাতে, তুমি প্রতিটি পাহাড়
প্রতিধ্বনি দিয়ে ভাঙো, নাম ধরে ডাকো-
যেন এইমাত্র চড়ুইভাতির
বন্ধুরা চলেছে ফিরে ভ্রমর-রঙিন কোনো গ্রামের ভেতরে।
তৃষ্ণার ভেতর থেকে পাখি উঠে আসে।
আমি স্পষ্ট দেখি, আর ভাবি;
কত দিব্যদেহ ধরে
অনুপম বীথির শরীর, কত রং ঝরে
বার্লাকবিস্তৃত এই আলোর শহরে।
হে ঝর্ণা আমার,
তোমার তৃষ্ণার ছলে পাখি ওড়ে আমার আকাশে ।।
নিরাভরন
শব্দ থেকে ঘুঙুর খুলে নি,
বাজুক একেলা।
মানুষজনের স্মৃতি ঘরের ভেতর-
ঘরের বাইরে? পশুপাখি, আরো মানুষ, অফুরন্ত খেলা,
শব্দে সব ধরে?
যদি তেমন ভেতর শক্ত হয়
তাহলে আর বানানো বাজনার
প্রতিধ্বনি কেন?
বাংলা ভাষা বড় হচ্ছে সমস্ত সময়-
এখন তার চরণ থেকে অবাঞ্চিত নূপূর
সরিয়ে নাও,
বেজে উঠুক শুধু-পায়ের খেলা ।।
অনন্ত মূর্হত
যা বলতে চাও
ঠিক সেদিকে স্পষ্ট করে তাকাও ;
কিছু নয়, বিশেষ কিছু নয়
দরজা খোলা পড়ে ছিল; ফাঁকা রাস্তা;
কোথাও কেউ নেই-
বাঁ-দিক থেকে একটা লোক এল !
কী বলতে চাও? পৃথিবী যে পলকে পলকে
পালটে যায়, সে তো সবাই বলে গেছে,
তবু যখন খোলা-রাস্তা একটিমাত্র লোকের তালে মাতাল
তখন তুমি কথা বলতে চাও- যেন তুমি মুখোস খুলে
আলো দিচ্ছ লন্ঠনের মতো-
অমন করে জ্বলতে চাও কেন?
সদর স্ট্রিটের বারান্দা
বারান্দা, রেলিং সব কাছে ছিল’
আমি দাঁড়ালাম, আর
ভোর হয়ে এল।
দেখলাম-
আর পাঁচজন বেশ সুস্থ, স্বাভাবিক,
চলার আদল যেন মূর্তিমান ছাঁচের আদল-
টান দিলে হাওয়ার ভেতর ভরে ওঠে।
শুনলাম-
মাতাল লোকটা নাকি মারধোর করেনি মেয়েকে,
চটি ঊড়ে এসেছিল দৈবাৎ হাওয়ায়ার জোরে
পাঁচিল ডিঙিয়ে,
আজ তার দু-নম্বর মেয়েটির কান্নার শ্রাবন
এই পাড়ার শানাই।
বুঝলাম-
যা কখনও ঠেকানো যাবে না
তা এতই একান্ত, সহজ,
তাকে নিয়ে জল্পনা করাও
যেন চোখ বেঁধে চলা ।।
প্রেরনা
প্রথম ধাক্কা কিন্তু বাইরে থেকে আসে;
ট্রামের হাতল ছুঁয়ে অভিন্ন কনুই বেঁকে যায়।
যা কিছু বলতে চাও, তার ভেতরের দিকে নামে নীরবতা,
কিন্তু যা কখনোই শুরু হতে পারে না, সেখানে
কিছুই কি ঘটে?
বাহির-ভুবন শুধু চাপা-দীর্ঘশ্বাস মনে হয়।
একটা জানলা তুমি খোলা রাখ, কিছু মানুষের শব্দ
যেন কাছে আসে ।।
অন্য কবিতার প্রতীক্ষা
ধরে ধরে কবিতা লেখার হাত
ভেঙে যায়, থাকে শুধু গাভীর মতন নীরবতা।
দাঁত-করাতেরা সব বনের ভেতর থেকে শিস দিয়ে ওঠে-
কবিতা কি তা মতো? মৃদু ও অমোঘ ? অবারিত
বুকের ভেতর থেকে বুকের বাইরে আলো ধরে?
ঝরা-পাতা ঠেলে তার ভাঙা সাইকেল নিয়ে এসেছে যুবক,
সে কি সিগন্যাল করে কবিতায়? করে কি জোনাকি?
ধরে ধরে কবিতা লেখার হাত থেমে যায়,
থেমে যায় ফাঁকি ।।
এ খেলা সহজ নয়
এ খেলা সহজ নয়, জলের ওপরে এক বিমূঢ় কলস ভেঙে যায়,
এখন কোথায় তবে কতটুকু ধরে রাখা যায়, কেন যাবে?
জলে দৌড়ে যায় জল, বিমূঢ় কলসে আর কিছুই ওঠে না ।
যদি শক্তি কিছু হত, ঠেকে যেত হাতে বা ভেতরে,
ইঁট বা কাঠের তৈরি, হাতির দাঁটের কৌটো পাথরে বাঁধানো,
অথবা এমন কিছু, গিঁঠ দিলে রুমালে আঙুল থেকে যায়।
এ খেলা সহজ নয়, জলে দাঁড় ফেলে জল, জলের আড়ালে
শুধু আমাদের দেহ কিছুটা সাঁতার কাটে, বাকিটা পারে না-
যদি ভরে নিতে চাই, জলের ভেতরে এক উন্মাদ কলস ভেঙে যায় ।।
বৃত্ত
আমি যেখানেই যাই
কিছু পরে
বৃত্তের ভেতরে ফিরে আসি ।
বুক বাঁধি, বাইরে যেতে চাই,
স্রোতের আঘাতে তবু কুটোর মতন ভেসে মরি-
আমার সমস্ত ক্ষত বিন্দু বিন্দু ঝরে যায় জলে ।
আমি যেখানেই যাই
ফিরে এসে
বৃত্তের ভেতরে কড়া নাড়ি !
কে আছ? ঈশ্বর? নারী?
নাকি আমারই আয়নার জোড়াতালি?
বৃত্তের পরিধি ক্রমে বড় হয় –
আরো বড়, আরো বড়, আরো ।।
পরিচিতার সৌজন্যে
এই তীব্রদিন থেকে যত নিই, তত থেকে যায় ।
ছোটো সিমলা ঘুরে যায়; শাদা রাস্তা রঙিন বাড়িতে
পোষা কুকুরের মতো গৃহিনীর উঠোণ নাচায় ।
ঠিক বান্ধবী নয়; পরিচিতা; এক যুগ পরে দেখা এই ।-
দীর্ঘদেহ স্বামী, আর ফুলের মতন শিশু সাজানো বাগানে ;
তারই জন্যে এত সব ? হতে পারে। সমস্ত সময়
এক বাঙালিনী তার উজ্জ্বল হাসিতে ঐ সমস্ত পাহাড়
নতুন গানের মতো বেঁধে নিতে পেরেছে বলে কি
শুধু দিন তীব্র হয়, দ্যুতিখণ্ড উজ্জ্বল আবেগ
সোজা প্রসপেক্টে গিয়ে সূর্যের ভেতরে করসায়?
আমি যতটুকু পারি, তার বেশি তখনো পারিনি, তবু যেই
দমকা হাওয়ার টানে সমস্ত আড়াল একাকার,
পোড়-খাওয়া কলকাতা বুকের ভেতরে নিবে যায় ।।
মেলা দেখাও
কোন জায়গায়, কোন কোন জায়গায়
তুমি আছ? তুমি, মানে মানুষ ;
রেডিওতে কারা গাইছ দেহলীর সাধন-
বাউল, তুমি বাইরে এসে বাবু সাজো !
সাধন-ভজন ভালো, কিন্তু ডেরা কোথায়,
বাড়ি আসতে দেরি হল, পথে দেরি?
কোন জায়গায়, কোন কোন জায়গায়
তুমি আছ? ঘৃণা-ভালোবাসায় তৈরী? ভারি গড়ন?
কলকাতা বা কেঁদুলি, আমায় মেলা দেখাও, মেলা দেখাও
আমি টিকিট কিনে মানুষ দেখব ।।
কলকাতা ও আমি
রাস্তায় দশটি লোক শুয়ে আছে ।
আমি ল্যাম্পপোস্ট হয়ে দাঁড়াতে পারিনি ।
খুব বেশিক্ষন আমি আলো দিতে শিখিনি এখনো –
আমার নিজের কিছু অন্ধকার আছে,
কিছু দ্বিধা, কিছু অসুবিধা ।
রাস্তায় দশটি লোক শুয়ে আছে ।
আমি একাদশ ব্যক্তি ; কলকাতা,
শুতে জায়গা দাও ।।
কবিতার জন্ম
আমি সব টের পাই !
আলিসায় একা কাক মুখে ভাঙা অন্ধকার নিয়ে
বসে আছে, তার ডানার ঝাপট
সোজা বুকে এসে লাগে ।
সে কি জানে, সে আমাকে একটু একটু করে
শব্দ ও ভাষার দিকে নিয়ে যায়?
এভাবে সংকেত করে সবকিছু-আমি লুফে নিই
যা কিছু খবর, বার্তা, প্রতিটি মূর্হুত জুড়ে
যা আমাকে রসদ পাঠিয়ে চলে আজীবন ।
কাক উড়ে যায়,আমি আমার কলম নিয়ে
স্তব্ধ পাতার দিকে ঝুঁকে পড়ি একা ।।
********************************