........অর্চনা
আচার্যচৌধুরী.......
(কাব্যগ্রন্থ- ‘একশৃঙ্গ অশ্ব’, ‘রিউকিউ’...)
(১৯৪১-২০১২)
নারীর অস্তিত্ব
এবং তার সহজ সামাজিক পরিপূরকতা নিয়ে
প্রজাপতিতন্ত্রে সংশয় সংরক্ষন যে রয়েই গ্যাছে তা আর নতুন করে বলার প্রয়োজন
রাখে না, যার অবশ্যাম্ভাবি ফলশ্রুতি গত এক শতকে বাংলা সাহিত্যে মহিলা কবি/লেখিকার ঘাটতি
অথবা নারীবাদ অথবা পুং হিগেমনির দ্বন্ধে আরক্ত নারী প্রতিবেদন, ঠিক যে জায়গা থেকেই
হয়ত অর্চনা রায়চৌধুরীকে কিছুটা হলেও রক্ষনপটুতার বাইরে চক্রব্যুহের বাইরে রাখা
যেতে পারে; পিতৃতন্ত্রকে আবিষ্কার করেননি
তিনি, নারীতন্ত্রকেও আত্মলাঘবের সমাধান হিসেবে প্রয়োগ করেননি , শব্দ নিয়েই তার
আনন্দকল্লোল; শব্দ নিয়েই পরমাত্মা গেয়ে ওঠা, সামাজিক সমস্তটাকেই করেছেন তার
শাব্দিক চতুষ্কোন, শেকড় করেছেন ফল করেছেন ছড়িয়ে দিয়েছেন সবটুকু এক আশ্চর্য
অনুপাতে। কিছুটা হলেও তার কবিতায় দাদা রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরী বা অগ্রজ
রনেন্দ্রকুমারের প্রশ্রয় দেখা যায় , সেই নির্জনতা, সেই প্রচারবিমুখতা, সেই
দৃষ্টিজগতের বাইরে কোলাহল প্রিয়তার বাইরে অনন্ত অখন্ড ফুলদানি নিয়ে তার রঙের
ব্যবস্থা নিয়ে অস্থির হয়ে ওঠাতেই আমরা খুঁজে পাই সদ্যপ্রয়াতা কবিকে। ময়মনসিংহের
মুক্তগাছার জমিদার বংশের সন্তান অর্চনা আচার্যরায়চৌধুরি। যদিও প্রথিতযশা অগ্রজের
ছত্রছায়ায় বড় হয়েছেন ,মহাসময়ের হিসেব লিখতে জড়িবুটি তুলেছেন কাব্যিক অনুরননের, তবু
তার কাব্যজগত কোথাও এক স্বতন্ত্র্য সংকেতধর্মী। কবিতায় উঠে এসেছে জনপ্রবাহের এক
রূপক ধ্যানলোক, যেখানে সুঠাম পুরুষ, ক্যালডীয় দৈবজ্ঞ আবার রিউকিউ দ্বীপবাসী
মেয়েটির মত বহুধার সুর শুনতে পাওয়া যায়, তাকে নারীবাদী বলা ভুল হবে তবে তার ছান্দিক কলসের ওপর গড়িয়ে পড়েছে নারীর নিবিড়তা নারীর নন্দন, লিখিত পটে
ধ্যানলীন হয়েছে পরমাপ্রকৃতি; কোথাও তার নারী চিরন্তন অধীনতার প্রতীক চিরন্তন
দৌর্ব্যলের প্রতীক অথবা চারছত্র শোকগাথার, যেখানে সে অনায়াসে বলতে পারে “তারই জন্য বেদনায় ভরে ওঠে আমার সমস্ত দেহ-মন/ ঘুমের ওষুধ খেয়ে আমি আর
ঘুমোবো কদ্দিন?” আবার কোথাও নিরুদ্ধকন্ঠ নারীকে দীক্ষিত করলেন র্যাডিকাল উত্তরনে-“ফিরিয়ে দিয়েছি তাকে নির্দ্ধিধায় তীক্ষ্ণ অপমানে/ পরিনত আমি আজ, অনুতপ্ত
বিদগ্ধ প্রাজ্ঞ মন..../এবারেও আমি অহংকারে ফিরিয়ে দিলাম অর্ধনর, অর্ধ অশ্ব,
প্রেমিক সেন্টরটিকে” । কেবল নারীকেন্দ্রিকতা নয়, তাঁর
গভীর এষনায় ছিল এক বিশ্ববোধ, প্রকৃতির সাকুল্যে এসে চাঁদ-ঊর্না-ঋতুর মত হাজারো
ইনইক্যুয়ালিটির থেকেই তিনি খুঁজতে চেয়েছেন সেই অনির্বাণ ভূলোক, সেই ব্যপ্তভূমি।
বাংলা কবিতার সাজগোজের কাছে এলে ব্রতকথার কাছে এলে দেখা যাবে আড়ম্বরের শেষেও সে
নিস্পন্দ উদাস কারণ তার শ্বেতপত্রে না সে মেনে নিতে পারে তার উত্তরসূরীকে না
উদ্ধার করতে পারে পূর্বসূরীর মানভাষা আর তাই প্রচার বিমুখ প্রতিষ্ঠান নির্জন অর্চনা
আচার্যচৌধুরীর মত কবিরা হাজারো মতাদর্শের স্থবিরে বাংলা কবিতায় রয়ে গেলেন
জনকদুহিতার মতই....
উন্মীলন
ঘনীভূত অন্ধকারে বসে আছি
আমি একা, কে জ্বালাবে তমোঘ্ন
বর্তিকা?
মশালচি বলে আমি, লন্ঠন
হাতে ফরাস সেও বলে আমি।
আকাশের চাঁদ হাসে, জ্যোৎস্না ঝরায়, মিটিমিটি হাসে
তারাদের দল,
তবুও তো ঘোচে না যে আমার
আঁধার, চোখে জল-
অতন্দ্র আমি প্রহর গনি
একা, আবার কবে দেখা দেবে সে।
হঠাৎ সম্মুখে
দেখি দিব্যদ্যুতি সুপুরুষ এক,
বুদ্ধিদীপ্ত মুখ আর দৃপ্ত
পদক্ষেপ, এক হাতে
গীতা, আর অন্য হাতে
সাংখ্য, জ্বলে ওঠে হাজার হাজার
ঝাড়বাতি যেন-
সস্নেহে আমাকে তিনি
দেখালেন বোধিদ্রুম তলা;
তারপর সন্নিবদ্ধ সন্তদের
বেদপাঠ আর সামগানে সুপবিত্র
সেই স্থান।
কোথায় তমিস্রা? কত আলো
বিচ্ছুরিত চতুর্দিকে-
নিঃশঙ্ক আমার মন, আমি আজ
একা নই, বুকে ধরে
আছি আমি পরিত্রাতা আমার
ঈশ্বর।।
পৌরাণিক
মেঘ নেই মাথার উপরে শুধু
তামার গম্বুজ।
আগুন ঝরছে দ্যাখো; আকাশের
গহ্বর থেকে।
এ যেন রোমের রাস্তা,
ছুটোছুটি করে লোকজন;
ইকারুস শূন্য থেকে জলে
পড়ে, কলহাস্যে মেতে ওঠে শিশুদের দল।
বড়োরা শঙ্কিত সবে,অমঙ্গল
সুনিশ্চিত ভেবে;
ত্রাসে হৃদয়টি কেঁপে ওঠে,
প্রলয় আসন্ন নাকি!
তবুও তো চলে নিত্য জীবনের
অনুপুঙ্খ কাজ।
কৃষকেরা হাল চষে শুকনো
মাটিতে, প্রেম করে প্রেমিকেরা-
ছেলেটি জড়িয়ে ধরে
প্রেমিকার কটিদেশ অবলীলাক্রমে,
চুম্বনে আসক্তি তারা কাছে
আসে আরো।
যৌন আলিঙ্গনে বদ্ধ ভুলে
যায় বাস্তব জগৎ,
জীবনে চমক কত, প্রকৃতির
নখদন্ত তুচ্ছ যার কাছে।।
কন্যাপ্রতিমা
বুলার জন্যে
সেখানে
যেতে কি হবে বহু দূরে?
এক পা মাত্র তার বেশি নয়।
খুব কি
কঠিন সে দেশে যাওয়া?
সে কথা বলবে তরল তুষার।
ঘূর্নি হাওয়ায় হাল্কা পালক।
কী কী
নিতে পারি সেখানে বলো তো?
একটি সুতো বা কুটোও নয়।
কী কী
ফেলে যাবো এখানে বলো তো?
মাতরিশ্বাই বলতে পারে,
আর পাণ্ডুর তারা।
যাবো কি
অনেকদিনের জন্য?
অনন্তকাল-অনন্তকাল-
কার সে
রাজ্য কে বা রাজা বলো
উত্তর জানে উপলখন্ড,
এবং আমার গান।
বিদায়
বানী কে বলবে আমাকে?
ঘন্টা বাজবে- ঘন্টা বাজবে-
আমার
অভাব কে বোধ করবে?
সে কথা বলতে সাহস হয় না-
চটপট, বুলা, এসো চুমু খাও।
প্রজন্ম
আজ আমি
গৃহে থেকে পরবাসী এক।
যে দুঃখী
মেয়েটি শালুক আঁচলে ভরে
পার হয়
সাঁকো, আমার চেয়েও ধনী সে যে
রামধনু
কল্পনায় সাতরঙা তার মনের আকাশ।
একদিন
মুখখানি ঢলঢলে হবে- লাবন্যে সে প্রকৃতির নিয়মেই
রোগাভোগা
এই মেয়ে যাবে প্রেমের জোয়ারে ভেসে
আর সঙ্গে
ভাসিয়ে নেবে কত পুরুষহৃদয়।
তারপর
তারও ঘরসংসার হবে, কোলভরে
কলহাস্য
করবে তার নাতি-নাতনি-সন্তান-সন্ততি।
মনের
মঞ্জুলে ঢুকে চলে যাই আমি
সেইদিনে,
নতজানু হয়ে সব স্তাবকের দল
প্রেম
ভিক্ষা করেছিলো সংরক্ত যৌবনে।
অতীত
মন্থনে কোনো ফলশ্রুতি আছে কি এখনও?
সম্মুখে
আমার আজ বিশাল সংসার।
বারান্দায়
সহকর্মীদের ভিড়, ছাত্রীদের ব্যস্ত আনাগোনা,
এই
মেয়েরাই রাতে সলতে হয়ে জ্বলে ওঠে, দিনমানে তারা
কলকন্ঠ পাখি।।
ডাইনির বাড়ী
আকাশে
সহস্র কোটি নক্ষত্রের আনাগোনা, লক্ষ লক্ষ ঋতু,
আলোকবর্ষ
পেরিয়ে চলে যায় মন।
উদ্ধত
যুবক, রুক্ষ এলোমেলো চুল, রাতজাগা রক্ত চোখ,
পোর্টিকোর
নিচে স্তব্ধ; থিরথির কাঁপে নিঃশব্দ অক্ষর,
হাতের
তালুতে, যার আকাশি প্যাডের পাতা।
টকটকে
লাল শাড়ি, অ্যালাবাস্টার হাতে চারাগাছা করে চুড়ির ঝিলিক।
দীপ্তহিম
চোখে চিলতে হাসির ঢেউ, চলে যায় মেয়ে,
গর্বে
দৃপ্ত ভঙ্গিমায়, বক্র তার গ্রীবা।
বোঝেনি
সে কোথায় গোপন ছিল স্মৃতি।
ঢেউজলে
ঝিলিমিলি কেটে যায় চাঁদ,
পৃথিবীর
মানচিত্র কত যে পালটায়,
নতুন
তারার মালা আকাশের গায়ে।
মধ্যপ্রাচ্য
থেকে তুহিন সাইবেরিয়া-
খুঁজে
মরে কোনো এক ব্যথিত ঈশ্বর।
তারপর
বিষন্ন খোঁপায় গুঁজে ডাইনির বাড়ি,
সে-আর
মানবী নয়, টিয়া নয়, একটি কম্প্যুটার ।।
প্রথম বান্ধবী
পঞ্চাশোর্ধ্ব,
বিগত যৌবনা, আমার মিতালি
রঙিন
কৈশোরে যার নিত্য আনাগোনা ছিলো আমাদের খেলাঘরে
এখন সে
অন্য মেয়ে, স্রোত নেই যার কালের নিয়মে।
শুনেছি
সে ব্যারিস্টার, আদালতে যার
প্রতিপত্তি
ছুঁয়েছে আকাশ। তার কথা বলি ঃ
চোখের
চুম্বকে আর সুঠাম দেহের বল্লরিতে
লুঠ করে
নিয়েছিলো যত সব যুবকের টগবগে মন,
তারপর
প্রমত্ত উল্লাসে করেসে সে ভ্রুনহত্যা কামোন্মাদ হয়ে।
আজ তার
পার্কস্ট্রিটে ফ্ল্যাট আছে, আছে গলফগ্রিনে,
সুমো
আছে, জেন আছে, আছে কনটেসা,
ছেলে
নাতি বর্তমান, স্বামী বর্ষীয়ান-
প্রেমের
খেলায় আজও জুড়ি নেই তার।
মাতৃভাবা
নয়, সে নয় পত্নীভাবা,
কাম,
অর্থ জীবনের একমাত্র ধ্যান-
বাকপটীয়সী
সেই অপরুপা নারী
গতপুষ্পী,
বেডরুমে টেনে নিয়ে যায় তার সুপুরুষটিকে ।।
বার্ধক্য
যখন যৌবন ছিল সহর্ষে জাগতুম ভোরবেলা।
আবার দিনের শেষে শিশিরের দুঃখভাগ নিতুম সহযে ;
এখন সকালে উঠি শুধু শাদা ঝর্ণাটিকে গালাগাল দিতে
যদিও সতেজ রাখে সমস্ত গাছের মূল; আহা যদি দুচোখের পাতা
নির্বোধ খড়খড়ি হত, আর তাকে চেপে
বন্ধ করে রাখা যেত পর্দা দিয়ে ঢেকে চিরকাল।
অজৈব এ-পৃথিবীর অন্তহীন ভার; কী আশ্চর্য সন্ধ্যাবেলা
লম্বা লম্বা ছায়াগুলি শুয়ে আছে কাটা বিকীর্ণ খড়ের মতো
উন্মাদ বৃদ্ধা ও আমি আনন্দে চঞ্চল হয়ে উঠি; পরমাত্মা গেয়ে ওঠে জয়গান;
হিমবর্ষী আকাশ ছড়ানো থাকে চারদিকে; মাঝখানে
জ্বলছে সে জীবন্ত উত্তাপে ।
এক শৃঙ্গ অশ্ব
(য়ুনিকর্ণ)
খিড়কি খোলা একলা আমি পুকুর পাড়ে-
জলের নিচে শালুক ভরা টুকরো আকাশ,
শূন্যে চিল, পাক খাওয়া চিল, কালোবিন্দু,
চতুর্দিকে নিবিড় বন শান্ত ছবি ।
হলুদ ক্রোটন, আগুন বাগান, আমরা দুজন,
লালডোরা প্যান্ট, বুশশার্ট, বন্ধু সেই
নিষিদ্ধ ফল, নিষিদ্ধ ফল, কাঁপছি আমি,
ঝাউয়ের ছায়ায় আমার শরীর অনির্বাণ ।
গীতিনাট্যে স্বপ্নে আমার নেচেছিলো
লম্বা নাক রঙিন এক মুখোশ এঁটে
প্রিয়তম বন্ধু আমার, স্বপ্নে দেখা;
দুলছে জলে তার সে ছবি কী অদ্ভুত ।
ভাঙা আয়না, কুচ্ছিৎ মুখ টুকরো টুকরো
নিরাপরাধ আমার মুখ কৈশোরের
স্বর্গছবি, গুপ্তবিষ, গুপ্তবিষ,
একশৃঙ্গ পুরুষ তোমার মৃত্যু হোক ।
কিমেরা
ঘাসের ফাঁকে পিছলে পড়ে হলুদ রঙের সাপ,
ফুল্ল এক মেঠো ব্যাঙের করুণ আর্তনাদ ।
ডোবার ধারে বটের ঝুরি সন্ন্যাসিনীর জটা;
স্বপ্নে দেখা তোমার মুখ ধূলোর মেঘে আঁকা ।
জলের মধ্যে সাঁতার দিই আমরা ডলফিন ।
কখনো ডুবি, কখনো ভাসি, অন্তরঙ্গ হই;
লিবিডোর কুটিল গতি ভাসে মাছের মড়া,
হঠাৎ আমিই ভেঙে দিলাম মধুর জলকেলি ।
হলুদ-কালো সাপের মুখ তীক্ষ্ণ আর্তনাদ ।
আগুন দিয়ে জড়িয়ে ছিলে তোমার দুই হাতে;
ভালোবাসা হারিয়ে গেলো ব্যাঙের চিৎকারে,
আমার কাছে পুরুষ তুমি আজব কিমেরা ।।
জরায়ু
একে একে সব খেলা শেষ হয়ে এলো ।
হাতে ছিল কিছু শব্দ, উড়ন তুবড়ি,
ছুঁড়ে দিই, সংরক্ত আলোর ফুলকি,
নীল শূন্যে দাগ কেটে ফুটে ওঠে আগুন অক্ষরে,
পৃষ্ঠবতী বন্ধুদল চমৎকৃত দেয় হাততালি ।
পাশের বাড়িতে এক ছোটো ছেলে, ফুটফুটে চাঁদ,
ফিটের ব্যারামে ভোগে, হঠাৎ বেহুঁশ ,
নাড়ি টিপে দুলে-দুলে কোয়াক ডাক্তার তাকে বলে;
‘মেজিক দেখবি মনি, আশ্চর্য ম্যাজিক।‘
কোনো এক সম্ভাব্য মণিকে আমি ম্যাজিক দেখাবো বলে
যত্নে রেখেছি তুলে লাল হরতন ।
আমার এ-মানচিত্রে যে-সমুদ্র এখন উত্তাল,
তার পারে তুমি আজ; মনপবনের নায়ে সে-অকুলে ভাসি
তোমাকে ধরবে বলে; কাঁকড়ার দাড়ার মতো তুমি প্রয়োজন ।।
১৯৫৬ সালে তুমি
সমুদ্রতল, সমুদ্রতল, একলা আমি ডুবি;
চতুর্দিকে বিচিত্রজীব, নানা রঙের মাছ,
ভয়ে আমি শিউরে উঠি, কখনো বিস্ময়ে,
বিশাল বিশাল পাহাড় আর নাম না জানা গাছ ।
কী জানি কী খুঁজে বেড়াই নিজেই জানি না যে ,
হঠাৎ চোখে পড়ে আমার সম্মুখে রামধনু-
নেচে নেচে ভেসে বেড়ায় শুক্তি না এক মেয়ে,
হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে দেখি কত রঙের ঘটা;
একটি মুক্তো জ্বলছে একা গর্ভগৃহে তার-
মুক্তো নয় তো ব্রম্ভাণ্ড সে, কম্পিত পনেরো,
উনিশ শো ছাপান্ন সাল, আমার মধ্যেই
আরেক বিশ্ব জন্ম নিচ্ছে- আমি কি নির্দোষ ?
হেলেসপন্ট
তুমি তো বলতে আমি নাকি ভুলবোই
ঝিনুকের ভাঁজ বারবার আজ খুলে দেখি;
গৈরিক জলে ঘুরপাক খায় বটের পাতা,
সিঁড়ির চাতালে স্তব্ধ দুপুর পাশে কেউ নেই ।
আমার ওষ্ঠে হাত রেখে তুমি বলেছো সেদিন;
সায়নারা তুমি বিশ্বাস রেখো আমার প্রেমে ।
পার হবো আমি তোমার জন্য হেলেসপন্ট ,
লিয়েন্ডারের মতোই কঠিন আমার প্রেম ।
আমি প্রমিথ্যুস আনবো আগুন স্বর্গ থেকে-
ভুলিনি তো আজও তোমার সে-সব প্রতিশ্রুতি ।
তিন সমুদ্র লেহন করছে পাহাড়তলী,
হীরের ঝলকে কুমারী কন্যা শুচিস্মিতা ,
সুদূর প্রাচ্য হাতছানি দেয়, জেট ধরো তুমি ,
জাপানী মেয়ের আলিঙ্গন বিস্মরনের লীথি ।
তোমার শপথ ঘুরছে এখন ঘাটের রানায় –
পুরুষের মন যেন আবহাওয়া বড়ই খেয়ালি ।।
সাঁওতালী মোহর
(১)
নাগরা মাদল শঙ্খ বাজে গাছতলায়
যুবক যুবতী নাচবে গাইবে আখড়াতে
আমরা আর পাতানৃত্যে নাচবো না
আমরা আর গাইবো না কেউ যাত্রাগান
পবিত্র এ সমাজদেহ রাখতে চাই পরিচ্ছন্ন
(২)
বাবা পুঁতেছিলো আটাল ফুলের গাছ
ছড়িয়ে গেলো সারা উঠোণময়
মা পুঁতেছে টগর ফুলের গাছ
সারা বাড়ি আলোয় আলোময়।
(৩)
আহা, দারুন গর্মি, কচি মেয়েটিকে নিয়ে যায়
ওরা শ্বশুরবাড়ি
ওহে বর, ও যে বড়ো লঘুভার, কাঁধে তুলে নাও
খই কি হাল্কা, অথচ চিঁড়ের কত ওজন ।
(৪)
কনেযাত্রীর বিরাট মিছিল, কে তুমি রঈস
পথ দিয়ে যাও
তারা বলে; দাও একটু আগুন,
জ্বালাবো আমরা তামাক-কুটি
কুটি ছুঁয়ে দিলে ঘাসের আগুন
নিভে যায় হাতে তৎক্ষনাৎ।
(৫)
প্রাসাদের মতো বড় এক বাড়ি বানিয়েছি
রোয়াকটি তার কোমর-সমান উঁচু
স্থির হয়ে বসো সে রোয়াকে এসে,
গালে হাত দিয়ে চিন্তা করো ।
আমাকে কি তুমি রেখে যাবে ঘরে-
আগুনের শিখা বউকে ।
(৬)
সর্ষের খেতে মুসুরি ডালের প্রচুর ফলন;
উঁকি দেয় কুঁড়ি, এখনও হয়নি সে যে ফোটা ফুল
দানা বেঁধে ফল,বুকের মধ্যে অণুকয়েক শস্যদানা ।
বরফ
শোনো,
যশ ,খ্যাতি , অর্থ, যৌবন, সৌন্দর্য সব ধূলোয় বিলীন ।
দেয়ালের
চতুষ্কোন আয়নায় তোমার চিন্তিত মুখ বলিরেখা আঁকা,
তুমি
লোলচর্ম বৃদ্ধ এবং দুই চোখ মরামাছ,
আমাকে
আঘাত দিয়ে কত দূরে আছো আজ হিমশীতল নক্ষত্রের মতো ।
তোমাকে
এখনো ভালোবাসি যেমন বেসেছিলাম সেই উদ্ভিন্ন যৌবনে ,
আমি
দীপ্যমান বাতি। আর তুমি? ক্ষীয়মান বস্তুপুঞ্জ বুঝি –
আমার
এ প্রেম তবু বেঁচে থাকবে নিরবধিকাল- আমি ভারতীয় মেয়ে,
অলৌকিক
ঘটনায় পটিয়সী । কত না বিদ্রুপ ভরে-
অনির্বান
আমার চোখের জল ফিরিয়ে দিয়েছ- যদিও তোমার চুলে
জমে
আছে লন্ডনের একরাশ শীতের তুষার ।।
************