70Th pOsT : কেদার ভাদুড়ী


(জন্ম-২৮ জুন ১৯২৫-)
(কাব্যগ্রন্থ-‘শুকনো জল’, ‘পাথরের স্লেট’ ,‘চারপুরুষ এক নারী’ , ‘তিনভুবনের প্রেম’ ,’এই তো ঠিকানা’ ,
’ শ্রীচরনেষু মা কবিতায় ‘,‘ নির্বাচিত কবিতা’ )

নেভি থেকে আমেরিকান এয়ারফোর্স,ওভারসিয়ার,চিত্তরঞ্জন সেবাসদনে ডায়েটেশিয়ান, সেখান থেকে ব্রিটিশ এয়ারফোর্স, দ্বিতীয় পর্বে ইংরেজী ভাষার শিক্ষকতা। এমন কবিকে বা তার দর্শনকে কি বলা যেতে পারে? কবি ও সাহিত্যিক উত্তম দাশ ভারতীয় দর্শনের ‘অপূর্ববস্তুনির্মাণক্ষমাপ্রজ্ঞা’ শব্দটি উল্লেখ করেছেন কেদার ভাদুড়ীকে আর তার কবিত্বকে আইডেনটিফাই করার জন্য; তবে  আমার মনে হয় কেবল প্রজ্ঞা নয় বরং একটা খোলামুখ একটা মুক্ত পরিসর একটা সদশয় কলম তার কবিতার উত্তরসাক্ষ্য হয়ে থাকবে; অনুশাসন মেনে কবিতা লেখেননি কেদার ভাদুড়ী, তার বেহিসেবী উদ্দাম  জীবনের মতই শব্দের বোধের লীনতাপেও কোথাও সেই বাহান্নপীঠের  অমৃতচক্র, কাহিনীর কার্নিভালেক্স,অথচ এই বহুজাতিক কথোপকথনে অদ্ভুত তপরতায় সামাল দিয়েছেন কথা ও কবিতার বমি আর আপেলের রসেদের,সেখানে লিনিয়ারিটি নেই,স্বজনহীনতা বন্ধুহীনতা যোগাযোগহীনতা নেই বরং অনুমোদন আছে একটি আন্তর্জাতিক কবিতার,বোধের লীনতাপের।প্রতিষ্ঠান বিরোধী নন বরং প্রতিস্ব পরিপন্থী বলা চলে কেদার ভাদুড়ীর প্রতিষ্ঠানকক্ষের নকশায় রচনায় পরিকল্পনায়;একটা হোলি অ্যালায়েন্সের মত তারাই যেন কেদার ভাদুড়ীর সম্পূর্ণ জীবনটাকে ট্রান্সলেট করছে।বারবার ঝুঁকি নিচ্ছেন ‘আমি’ থেকে ভয়ংকর মশকরা খুলে নিতে মিথ্যে জীর্ণ অনুঢ়া মেঘ খুলে নিতে। তবে আপনি কি এলিটিস্ট আর্টপিস খুঁজছেন কেদারের কবিতার  মালবিকা -মৃত্যুঞ্জয়ে? বাংলা কবিতার কোনো কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ড থেকে তবে কি খুঁজছেন অভিজ্ঞতার সাবজেকটিভ বর্ণনা? প্রিঅকুপাইয়েড ইনটেনশেন? না,তার কবিতার কাছে করতালি ক্রমশ মিলিয়ে এসেছে, মিলিয়ে এসেছে সাফল্য মরীচিকা, কোথাও কোথাও কেদার ভাদুড়ীর কবিতা উদবাস্তু বা ছিন্নমূল –যেন এক কনফিউজড রিয়ালাইজেশন,’আঁশ পড়ে আছে ফ্যাকাশে ও সাদা’,টাইটেল সং থেকেই সে এক বাক্যহীন বিগ্রহ,আহ্লাদিত পাঠক বা অ্যাল্ট্রুয়িস্টিক সার্কেলের অস্বীকৃত ফ্রেমওয়ার্ক সেখানে, তিনি সেই শৈলীনির্মাতা যার ভেতরে ভেতরে বুখারী জ্বলছে, যার কাংড়ির মধ্যে ছাইচাপা নিজস্ব এক বয়নভঙ্গী,পঠনভঙ্গী ,বিশ্লেষনের অগম্য এক পোস্ট জেনেরিক আগুন;স্বপ্নাদেশে লেখা কবিতা কেদারের নয়। না, তাঁর সাকরেদকেও তিনি ডাকেননি চালু সলিলিকি বা সনেটে বরং তার কবিতায় লেখনীর বেড়া ভেঙে বাচনই হয়ে উঠেছে “বৃষ্টি নামাবার কিংবা বহ্নিশিখার কোনো সংকেত”।তার পান্ডুলিপি প্রতিক্রিয়াশীল,বাইপোস্ট করে বাড়িতে পাঠাবার কোনো ব্যবস্থা  নেই,কেবল সকাল সন্ধ্যায় শিস দিলেই জানলাটা খুলে যাবে দরজাটা হাট হয়ে যাবে সুরারোপ হয়ে যাবে সমে শূন্যে।কেদার ভাদুড়ি কোথাও বাংলা কবিতার টাইটেল হোল্ডার হতে চাননি,বিষয়কেন্দ্র থেকে খুঁজে নিতে চাননি মেইনস্ট্রিম ব্যান্ডিং,বরং ‘মহাদিগন্তে’ পেয়ে গেছে তাঁকে,মাথার নিচে বেলুন নিয়ে শুয়েছেন কেদার,যেন সমস্তকিছু কনভেনশনাল বিষের শেষে এই তার বন্ধুত্ব;বাংলা সাহিত্যের নান্দনিক নীতিধর্মের কপচাত থেকে অসহায় ও নির্বোধ কাইট মেখে যে চিলটি উড়ে যায় তাই যেন কেদারের কন্ঠমনি, যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি বলতে পারেন-“একটা কবিতা যখন একবার পড়েই লোকে বুঝে যায় তখন বাঁদরামির নীল ইতিহাস আমার জানা হয়ে যায়। আসলে কবিতা তো মেয়েমানুষ। যদি সুন্দরী হয় তো কথাই নেই।“ অথবা “…মাকাল ফল আমি দেখেছি; কি সুন্দর রূপ, রেখা ,রঙ । ভাঙলেই সোডোমের আপেলের থেকেও জঘন্য, মনে হয় ডেড সির কাছাকাছি ফলে কিনা,তাই” ।পূর্বপুরুষ ও উত্তরপুরুষহীন কেদার ভাদুড়ীর কবিতা তার রসও খুঁজেছে নিজের মত করে, বিবর্তনও চেয়েছে স্বকীয় ,সেখানে অনুকরনকে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুর অথরিটি আর তাই তাঁর ইমপালসকে কোনো ভাষাসাহিত্যের ল্যাবরেটরিতে পাঠাননি কেদার বরং শিল্প সাহিত্যের সবল বুদ্ধিধর যে উপত্যকা জুড়ে গাছগুলো পত্রহীন, ভাষাভূতের কংকাল যেখানে,সেখানেই গড়িয়ে দিয়েছেন তার পহেলগামের পাথরগুলো যারা গড়িয়ে গড়িয়ে অমরনাথ গেছে আর দেখেছে কবিতার পায়রাদুটো এখনও বেঁচে ;ওরা ঘুমায় না, একজন অভিজ্ঞতার দীপ্তি জড়িয়ে থাকে একজন প্রকাশভঙ্গির সজীবতা;গ্রস্থ উপত্যকার কবিতা নিয়ে জেগে থাকে এক নতুন কেদার দর্শনে ।

ময়ূর

বেশ মনে আছে, বাবা একবার এক ময়ূর পুষেছিলো ।
কারণ? বাড়িতে গোখরো সাপের বড়ো আনাগোনা, তাই ।
বাবা ওকে কিছুই খেতে দিতো না, তবুও
বর্ষাকাল এলে ফুলে ঢোল, পেখমে পেখমে ছয়লাপ ।

তবে সবসময় নয়,মা কাছে গেলে তবেই
এমন পেখম মেলে দিতো, দাঁড়াতো, নাচতো, দেখবার...।
প্রথমে বুঝিনি আমি ও বাবা, মা লজ্জ্বায়
বুকের আঁচল টেনে দিয়ে আড়ালে যেতেই, যার নাম রেখেছিলো কার্ত্তিক ঠাকুর ।

জীবনে এর চেয়েও বড় দেহভোগ, সৌন্দর্যশিকারী (ভিখারি)
কখনো দেখিনি । আমি মার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে...

মনে করতো বুঝি স্নেহ পরবশ হয়ে গেছি আমি
কিন্তু বাবা একদিন রাগে দোনালা বন্দুক নিয়ে গুলি করতেই মা,
যে কোনোদিন বাবার নাম মুখে আনেনি
বলে উঠলো ঃ  রা ঘ ব , রা ঘ  ব !

আর আমি এই কালকুট্টায় পালিয়ে এসে হবনব হবনব করে
নাম নিয়েছি সৌরভ । বোঝো ।

কাব্য

আমি যুবতীটিকে বললামঃ সাবান যে মাখো, সাবানেরও
একটা স্নেহভাব আছে । শাড়ি যে জড়াও, গায়ে
শাড়িরও একটা সূত্রভাগ আছে । সেই স্নেহভাব, সূত্রভাব-
নিয়েই তো ভালোবাসা, নয় ?

শুনে ও দেখি তখনো চুপ করে রইলো, যেমন যুবতীরা থাকে ।
দাবদাহ এমনই যে অরণ্যে লেগেছে আগুন, আগে ।

বইমেলা-৯৩, এবং কয়েক ফোঁটা আধুনিক অশ্রু

এবার বইমেলায় গিয়ে দেখি ফাঁকা
ফাঁকা মানে? বই আছে, বুকস, কিন্তু অক্ষরগুলো নেই
ফাঁকা মানে? লোকজন আছে, কিন্তু মানুষজন নেই
সজল পাইপ টানে, আমি চুটা , তামাক বিহীন
কাঁচাপাকা দাড়ির ভিতরে ধোঁয়া জমে, জমে লালন ফকির
অশোক পদ্যের পেছনে কয়েক সহস্র কাস্ক মদ্য উড়িয়ে এখন

এখন? বইমেলায় গিয়ে দেখি ফাঁকা
ছড়া ও কবিতা যারা উগরে দিতো প্রতিপদে জ্যোস্নার ভিতরে
তারাও নিস্তেজ যেন, নিথর নীরব

তাদের  জীবন ঘোড়াগুলো, উটগুলো
ঐতিহাসিকের পাতা ছিঁড়ে, পাতা ছিঁড়ে খেতে চায়
লবণবিহীন

এমনি খবর
মালিনী যে মেয়ে, চিকন শাড়ির মতো আলো, এখন কোথায়
মালবিকা জানে, মৃত্যুঞ্জয় জানে, উত্তম জানে না
এবার বইমেলায় গিয়ে দেখি  ফাঁকা
অতীন্দ্রিয় বলেছে জবর ঃ মস্য-নিগমে শুধু
হৃদয়ের বাইপাস ছিঁড়ে আঁশ পড়ে আছে ফ্যাকাশে ও সাদা

শেষ প্রেম

যুদ্ধে যাবো কাল । আজ এই হিমহিম ভয়ার্ত সন্ধ্যায় আমি
গৌরবের জয়গাথা পড়ে যাব শুধু? নাকি ইতি-
হাস ঘেঁটেঘুটে মিশরীয় সভ্যতার ফ্যারাও আমল থেকে
অ্যাসিরীয়, ব্যবিলনীয়, চৈনিক, মহেঞ্জোদারোর
স্পার্টান পদ্ধতি জেনে নেকড়ে ও রোমুলাস , রোম...মহাব্যোম
থেকে ফিরে আসে, হ্রীং । টেস্টের দরোজায় দেখি পিয়া, অলিম্পিয়া,
নিতম্বে উন্মুখ ।

আমি তাই দুই কাস্ক মদ্য নিয়ে ওর সামনে রেখে
বলে উঠি খা । ও খেলো, খেয়ে নিঃশেষে ফতুর করে দিলো পিপে ।
আমি ওর গা টিপে গা টিপে চুমোয় ভরে দি যোনি,
রহস্যের ঘ্রাণ, যা খাজুরাহোর মন্দিরে অক্ষত
আছে আজো, আর বিংশশতাব্দীর এই কালচক্র
শিল্প শিল্প বলে ঐতিহাসিকের ক্ষুধা, যদি দুষ্ট, আণবিক
কাল যুদ্ধে যাবো, বর্শাবিদ্ধ মরে যাবো, পড়ে যাবো ঘুড়ির পায়ের ক্ষুরে
মৃত্যুর অধিক ।

 

মদ্যপ

ঘরটায় তালা দিয়ে অমিয় বেরিয়ে পড়লো
সিগ্রেট কিনতে । একঠোঙা কাজুও কিনবে বোধহয় । শশা ।
আমি বললাম ঃ কিরে, টিভিটা বন্ধ করবি না ?
বললো ঃ আরশোলা ও ইদুঁর, বিছানাপত্তর,
ঘরের জানালা দরোজা, সিলিঙের শুনতে ইচ্ছে করে না?
আমি আর কোনো শব্দই জোগাড় করতে না পেরে
বললাম ঃ মদ্যপ ।


ভারতবর্ষ

মা এর বয়স বাহান্ন, বাষট্টি বা ওরকম, ওর বেশি হয়ে  গেলে সত্যি
মা আর মা থাকেন না হয়ে যান মাতা, মাতাজী , নতুবা বঙ্কিমী ভাষায়
মাতাঠাকুরানী ।

পূর্ণগিরি যাচ্ছি। চড়াই উতরিয়ে দেখি এক যুবা, সুঠাম সুন্দর ।
চলেছেন হেঁটে । মাথায় বিশাল এক ঝুড়ি, বেতের । ঝুড়িতে বসে আছেন এক বুড়ি
থুড়থুড়ি, ক্রিপলড, ফুলে ফলে আঁকা মাতাঠাকুরানী ।

প্রায়ই বলছিলেন ; চল বেটা চল সুন্দর ; দিমাক সে পাঁও চালাকে চল ।
দো ভাষীর কাজ করি তো ! মম কে বুঝিয়ে বলছিলাম ব্যাপারটা, তাই ।
পূর্ণগিরি কী? কে? বাহান্ন পীঠের সারবস্তু কোথায়? যমনা বা বেত্রবতীর
তীর থেকে এইসব বুড়ীরা কেনো আসে কেনো যায় ।

পুত্রের অহংকার তো বলিইনি, তবু
সেইদিন রাত্রেই নেহরু লকনৌ এয়ার পোর্ট থেকে দূরভাষ পেলেন;
না আগ্রা নয় আর, বুলন্দদরওয়াজা নয় কিছু,
কনট সার্কাস নয় ভালো, লালকিল্লা, মেরিন ড্রাইভ,
মীনাকষী টেম্পল, তাজ । দেখা হলো, দেখা হলো আজ
হোয়াট ইন্ডিয়া ইজ, হোয়াট ইণ্ডিয়া ওয়াজ । বাই...




উড়ান

পাখি,      গান গায় ।
পাখি,      গান গায় না ।

এ কিরকম হলো?
একবার বললেন, পাখ গান গায়।
আবার বললেন, গান গায় না ।

প্রথমটায় হ্রস্ব ই
দ্বিতীয়টায় দীর্ঘ ঈ, লক্ষ্য করেছো?

দীর্ঘ ঈ গান গায় না, মেয়ে পাখী কিনা, তাই ।
তবে সে কী করে? কী করে?
বাসা বাঁধে, ডিম পাড়ে , বসে থাকে,
তা দেয়, পরে বাচ্চা হলে,
মেয়ে  পাখীই কি,
ছেলে পাখীই কি,
উড়ান শেখায় ।

চাকরি

আমি মরতে-না-মরতেই আমার বউ, সুধন্যা
পাশেই ছিলো, শিয়রের কাছে,
বলে উঠলো, মৃদু নত এবং স্বাভাবিক সুরেই
বলে উঠলো, আঃ বাঁচলাম ।

আমি এখন সবে বুক ছেড়ে বুকের ওপরে উঠেছি ;
এখন, একটু বিশ্রাম নিয়ে সিলিং ভেদ করে
উর্ধ্বে চলে যাবো—

‘আঃ , বাঁচলেম !’ শুনে
এ এক আজীব বা
এ এক অবিনশ্বর সত্য, মনে হলো ।

শ্বশ্রুঠাকুরানী এলো, বললো;
বলেছিলেম না? প্রেম কর, প্রেম কর, প্রেম কর
বলেছিলেম না? এ বড়োকে বিয়ে কর,
চাকরি পেয়ে যাবি, অন হিউম্যানেটেরিয়ান , নাকি… কি বলে?
কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডস ?
পশ্চাদ্ভাবন করে লাভ নেই ।
বাইশ বছরের সুধন্যা ছাপ্পান্ন বছরের বুড়োকে
প্রেম করে বিয়ে করেছিলো শুধু কি এ কারণেই

আমি আগন্তুক স্বর্ণরথকে ফিরিয়ে দিয়ে
বাড়িরই বেলগাছে ব্রম্ভদত্যি হয়ে বসে
পা দোলালেম পা দোলালেম, কান মললেম, কান মললেম
পরিশ্রুত সারসের মতো শীর্ষাসনে অতি দীর্ঘকালে ।

গৃহ

একটি গৃহ বানাবার ইচ্ছে ছিলো কোন এক নদীর ধারে চওড়া
বাড়ীটি কি চওড়া, নাকি নদীটি-ই চওড়া?
পণ্ডিতগণ ভাবুন, তক্কে লেগে থাকুন, আমিও ইতিমধ্যে
বাগান সাজিয়ে নি ফুলফললতাগাছে বর্ণানুক্রমিক ।
পুকুর অবশ্য আছে, পুকুরেও নৌকা-গৃহ ঢেনকানলে
যেমন পাওয়া যায় ।

গৃহের প্রতিটি ঘরে বউ, বউ নয় বই ; দুঃখিত ! দুঃখিত
এ বয়েসে কি যে হয়, বই বলতে বউ বলে ফেলি ,
অবশ্য দুটোই এক, কেননা পাতার পর পাতা
শুধু সমারোহ জ্ঞানের ধ্যানের ভ্রমণের রহস্যের
জ্যামিতিক, ততোটা হিসাব কষিনি, কেননা সুক্ষভাগে
দুঃখ লেগে আছে কিঞ্চি অধিক ।


বৃক্ষরোপণের কাব্য

মাদামকুরীর মতো মুখ নিয়ে অমিতাদি আমাদের
                                   অঙ্ক নয়, ইংরেজি পড়ান ভালোই
কি তার উচ্চারন, কি তার চটজলদি কতাহ ! বলেন ঃ ভবাই,
আমি একটি পাখি দেখিতেছি, ডু ইট ইনটু ইংলিশ, ড্যু, কই
দাঁড়াও হ্যাঁ বলো , কী? আয়াম সীইং আ বডি ? ছাই !

বলেই, সবুজ ও হলুদ চক দিয়ে সত্যি সত্যি
                                   একটি পাখি আঁকলেন, পরে লাল
আমরা এতোগুলো ছেলেমেয়ে, কিছুই বুঝিনা, কাকে
বলে ভার্বস অব পারসেপসনস, কী তার রূপ,
                                   ইউসেজ, শুধু চন্দ্রমল্লিকা রুমাল
দিয়ে চোখ মুছলো ঃ আমি গিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডে একটা গাছ
                 লাগিয়ে দিলাম, পাতাবাহার, অমিতাদির ডাকে ।

বৃক্ষরোপণ মানেই অক্সিজেন, বৃক্ষরোপণ মানেই অক্সাইড,
                                       বৃক্ষরোপণ মানেই......, চুপ
আজকে বৃষ্টির দিন, বৃষ্টি হলো খুব ।

শিস

বাড়ির পাশ দিয়ে তো যাও, একটু শিস দিয়ো শুধু ।
শুধু শিস নয়, শিসে যেন শব্দ থাকে, সুর থাকে,
ভাষা থাকে, ভালোবাসা, গম্ভীর গম্ভীর কোনো বোধ,
বোধের অতীত কোনো? যেন থাকে স্বর্গসন্ধি , তাও?

বাড়ির পাশ দিয়ে তো যাও, একটু শিস দিয়ো শুধু
সকালে সন্ধ্যায়, এই কথা বলেছিলো মেয়ে; তাই
আমিও না মৃদু নীল উচ্চগ্রামে সকালে সন্ধ্যায়
ওর-ই গলায় ওকে প্রতিদিন শিস দিতে থাকি ।

শুনে মেয়ে স্থির থাকে কভু? জানালাটা খুলে যায়,
দরোজাটা হাট, জোড়াসাঁকো কেঁপে যায়, উত্তমর্ণ
অধমর্ণ মিলে যায়, দারিদ্র্যনিকাশী সত্যে কবি
বেদ ও উপনিষদ থেকে সাদা রক্ত বের করে
যেন ছবি, অসীম মরমী ছবি বাইশে শ্রাবণে
জনে জনে জনারণ্যে সমে শূণ্যে ক্রন্দনে ক্রন্দনে ।

সমকামিতার স্বপক্ষে

শত সহস্র ফটোগ্রাফার, সাংবাদিক, নাগরিক নিমন্ত্রন পেলো
আর আমিই পেলাম না? এ কেমন হল জাঁ লাইলফ?
আমি দুনিয়াজোড়া কবিতা লিখি তুমি জানতে,
আমার নিমন্ত্রন তাই অবশ্যম্ভাবী ছিলো,
কিন্তু তুমি ভুলে গেছো, স্বাভাবিক ।
যেখানে বিদ্রোহ একচল্লিশ বছরের  সেই আটচল্লিশ থেকে
সেখানে বিপ্লবীদের মাথার দিব্যি দিয়েই বলছি আমার মনে করার কিচ্ছুটি নেই

কোপেনহেগেন ! কোপেনহেগেন ! তোমাকে শুভেচ্ছা
আমি একবার ড্যানিশ সসেজ খেয়েছিলাম অসম্ভব ভালো ।

তোমার বরের নাম, কাগজ়ে পড়েছিলাম, জোক ভকম্যান
জার্মান জার্মান গন্ধ পাচ্ছি যেন । সে যাই হোক
ম্যান তো বটেই, শুধু ম্যান নয়, হি-ম্যান তো বটেই ।
নইলে এমন করে সমকামিতাকে স্বর্গভূমে নিয়ে আসতে পারতো না ।
আসলে সভ্যতা জানুক, শিক্ষাও জানুক, সংস্কৃতিও জানুক
যেখানে দেহ ও মনের মিল, মিলন, সেই তো বিবাহ
আমরা অপোগণ্ড, দেহ বলতে স্ত্রী বুঝি, মন বলতে পুরুষ
কোপেনহেগেন! কোপেনহেগেন ! তোমাকে শুভেচ্ছা
আমি একবার ড্যানিশ পনীর খেয়েছিলাম অসম্ভব ভালো ।

মাদাম ওয়াধোওয়া

ধরা যাক
মহিলাটির সঙ্গে, ভদ্রমহিলাটির সঙ্গে
প্রথম দিন আলাপ হলো, একটু ।
দ্বিতীয় দিন তার-ও বেশি ।
তৃতীয় দিন আর-ও ।
চতুর্থ দিন ......

ধরা যাক
ভদ্রমহিলাটির নাম মাদাম ওয়াধোওয়া ।
ধরা যাক বাংলা বলতে পারেন ভালোই ।
বললেন ঃ আপনি গাছে উঠতে পারেন?
বললেন ঃ আমার বাড়িতে একটা পলাশ গাছ আছে ।
তার একটা ডাল, বেশ মোটা ডাল
আমার ব্যালকনির গা ঘেঁসে, প্রায় গা ঘেঁসে
সোজা চলে গেছে সীমান্তের সন্ধানে ।
মাঘ ফাল্গুন এলে ফুল ফোটে ।
আমি চন্দ্রালোকিত জ্যোস্নায়
দরোজা জানালা খুলে
গভীর গহন তাকিয়ে থাকি, একাই ।

তারপর?
কবি ও প্রাবন্ধিক উত্তম দাশের দেয়া
পঞ্চম মেরুকরন নিয়ে
গলায় মিষ্টি মিষ্টি ঢেলে বললেন ঃ
আপনি ডাক ও ডাহুকের স্বাদ
কিছুই বোঝেন না।
আপনি বড় বোকা ।
বলেই ষষ্ঠ ফ্যারাও, তার সঙ্গে
তুতেনখামেনের পিরামিড দেখতে
হাসতে হাসতে বেরিয়ে গেলেন, গীর্জায় ।


*******************************

69Th pOsT : তুষার রায়


........তুষার রায়.......
(১৯৩৫-১৯৭৭)
(কাব্যগ্রন্থ- ব্যাণ্ডমাস্টার, গাঁটছড়া, মরুভূমির আকাশে তারা , অপ্রকাশিত তুষার ...)


সেপ্টেম্বর ১১,১৯৭৭।বালির পাহাড় নিয়ে খেলতে খেলতে আর শব্দের ঝিনুকে পকেট ভর্তি করতে করতে বিষাদের চিহ্নগুলোকে আরও বড় করে ফিরে গেলেন ব্যান্ডমাস্টার।দুপাশের বারান্দা থেকে বেরিয়ে এলোনা ছেলেমেয়েরা , কোথাও পতাকা অর্ধনমিত হোলোনা,কেবল শান্তিতে পুড়ে গেল ব্যান্ডমাস্টার আর তার বিলীয়মান শব্দ।মৃত্যুকে নিয়ে উপহাস মৃত্যুকে নিয়ে যার বাজি যার অস্থিমজ্জা লোহিতকনা সব অনিয়মের ব্যকরণে ভরা ,তিনি তো জ্বলতে চাইবেন না প্রদীপ বা প্রণামের মত, সেটাই তো স্বাভাবিক,বরং সব আলো জ্বেলে আমরা যখন ঘুমাবো, সব কবিতা লিখে আমরা যখন ঘুমাবো তখন তিনিই একমাত্র দেশলাই জ্বেলে জ্বালিয়ে দিতে পারেন তারই শরীর।রক্তের ভেতর চলমান শেকড় রক্তের ভেতর বিস্ফোরনের শব্দ এভাবেই কি বাংলা কবিতাকে সেলিব্রেট করতে চাইলেন তুষার!  আশ্চর্য আপেল রঙ তার অনাবিস্কৃতই রয়ে গেল অথবা তার উত্তরসন্ধানে ছিলইনা কোন মহৎ কবিতা কোন পূর্বজন্ম কোন পরজন্ম।মাত্র ৩৭ বছরের জীবনে দূষিত রক্তকে নিয়ে যেভাবে নিজেকে ধ্বংসের যোগ্য করে তুলেছিলেন রঅ্যাঁবো, ঠিক সেভাবেই কি ইন্দ্রিয়সমূহের সচেতন বিশৃঙ্খলা সাধনই হয়ে উঠল তরুন কবিদের মুকুটহীন রাজা ব্যান্ডমাস্টার তুষার রায়ের কবিকর্ম!তিনি কি রঅ্যাঁবোর মতই ঘোষনা করলেন-দি পোয়েট টানর্স হিমসেলফ ইনটু ভিসনারি বাই এ লং, ড্রাসটিক অ্যান্ড ডেলিবারেট ডিসঅডারিং অফ অল হিজ সেন্সেস!তুষার রায় প্রসঙ্গ এলেই চলে আসে অন্তিম অজ্ঞতা অন্তিম সংকোচ পেরিয়ে আসা এক উচ্চকিত ডিকশন,যেখানে কবি নিজেরই রক্তের চাপ বাড়িয়ে রেখেছেন , নিজেই সাজিয়ে রেখেছেন নিজের চিতাকাঠ,সমাজ স্রোত আর প্রতিষ্ঠার সমান্তরাল রাস্তায় তুষার হেঁটেছেন একা;খাদের ধারে গিয়ে ঝুঁকে দেখেছেন নিজেরই ভারাতুর শেকড়গুলো , যেন উচ্চতম ট্রাপিজে ডিগবাজি খাওয়া এক ক্লাউন যিনি এস্টাবিলিশমেন্টের নামাবলী লুকিয়ে আসেননি, আসেননি আত্মা বিক্রি করে,আর অভিমানে ছিঁড়ে ফেলছেন কাঁচা ব্যান্ডেজ কেবল এক চরম অভিমান এক ভয়ানক তৃষ্ণা নিয়ে যেখানে এক ট্রাক থেকে অন্য ট্রাকে ট্রাফিক সিগন্যাল ভেঙে তুষার ছুটে চুলেছেন রাস্তার প্রস্তাব নিয়ে রক্তের প্রস্তাব নিয়ে-কেবল এই প্রিয় দেশ যেন পুনর্বার বাসযোগ্য হয় । ষাটের আন্দোলিত আক্রান্ত বাংলা কবিতা বাজারে তুষার যেন অবলুপ্ত আবহাওয়ায় এক তামাটে আবিষ্কার ;যিনি শরীরের সব গ্যাস তেজস্ক্রিয় গিলে নিয়েছেন , শীততাপ নিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষার আসনে তার শিল্পপিয়াস  নয় বরং ঠাসা মানুষ আর ফাঁপা মানুষই হয়ে উঠেছে তার যাবতীয় নেশার অধীন ।অজয় নাগ, তুষার সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তুষার রায়ের এক অদ্ভুত খেলার শখের কথা উল্লেখ করেছেন ।খেলাটা ভারী মজার, রাস্তার সিগন্যাল না মেনে চলন্ত গাড়ীর গতিকে ফাঁকি দিয়ে ফুটপাত বদল করার,যেন এক জীবন পার হয়ে অন্য জীবনে যাওয়া। এতে যে কোনো সময় মৃত্যু আসতে পারে । তুষার বলতেন, মৃত্যু নয় জীবনের খেলা। শেষের দিকের কবিতায় কোথাও জীবনকে  নতুন করে শুরু করার ইংগীত পাওয়া গেলেও তুষার কি সত্যিই নতুন জীবনের প্রত্যাশী ছিলেন? আত্মহননই কি ছিল না তার ইহজীবনের অভিভাবক! দুঃখের সময় হাসতে চেয়েছিলনে তুষার, অভিকর্ষহীনতায় ভাসতে চেয়েছিলেন, কোনো রিসোলিং বা কুহুরবে কম্যুনিকেট নয় বরং ব্রম্ভাণ্ডের চৈতন্য সুতোয় তিনি ছিলেন সেই মুক্ত ধ্বংসপ্রেমী গ্ল্যাডিয়েটর যিনি ভারসাম্যবিচলিত মানডেন সমাজের মধ্যবর্তী শূন্যতায় দাঁড়িয়ে, দু  হাজার সাবমেশিন গানের সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠতে পেরেছিলেন ট্রেটার ট্রেটার শব্দে।পৃথিবীর বিপনিতে কুঁচো কুঁচো হয়ে উড়ে বেড়ায় অভিমানী তুষারের স্বল্প সোডা মেশানো মদের মত অন্ধকার আর বারবার শুনিয়ে যায় শেষপর্যন্ত না সারা এক অসুখ,শুনিয়ে যায়-গনগনে আঁচের মধ্যে শুয়ে এই শিখার/রুমাল নাড়ছি/নিভে গেলে ছাই ঘেঁটে দেখে নেবেন/ পাপ ছিল কিনা ।ঠিকানাবিহীন অসংখ্য ফুটপাতের কোন এক ফুটপাতে আমরা যে ব্যান্ডমাস্টারকে দেখি, সামাজিক স্বত্তা জগৎস্থিত স্বত্তাকে চাঁদের আলোয় পুড়িয়ে দেওয়া যে তুষারকে বাংলা কবিতা দেখে সে আসলে জমিদারের রক্ত নিয়ে জন্মানো, পলেস্তারা খসা,ভগ্নপ্রায়,পরিচর্যাহীন জমিদারের এক বংশধর, সেই তুষার যে অভিভাবকের যত্ন স্নেহের জন্য আকুল আর এই তীব্র দহন আর অস্বস্তিকর ডিলেম্মা থেকেই উঠে আসতে দেখি আরও এক তুষার,অনিয়ম অনাচার আর বাউণ্ডুলে তুষার, যে তার নিজের সমাধি ফলকের জন্যও কবিতা রেখে যান- সেই কবি শুয়ে আছে এইখানে/তিনটি বুলেট বুকে নিয়ে শুয়ে, আছে এইখানে/সেই কবি মিছিলের ঠিক পুরোভাগে ছিলো/তিনটি বুলেট তাকে শুইয়ে রাখেনি, জেনো,/ভালেরির মতন ফিরছে সেই কবি; ফিরে এসে/তিনটি বুলেটে ঠিক মৃত্যুকে কিনে শুয়ে আছে । ষাটের  উন্মত্ত ক্রান্তি থেকে সত্তরের অগ্নিগর্ভতা-এই পুরো সময়টাই তুষারকে সেই ফ্যাকাশে জীবনের সামনে আত্মজিজ্ঞাসার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় যেখান থেকে তিনি ক্রমাগত এক মৃত্যুশিল্পী হতে চেয়েছেন,সমগ্রের এক খণ্ড নয় বরং অনুসরন করতে চেয়েছেন সেই ল্যম্পপোস্টটিকেও যেখানে তাকেই তোলা হবে অনন্ত যীশু হিসেবে; অজানা আঁধারে ক্রমশ গেঁজে ওঠা এক কবি, জ্যামুক্ত তীরের মত সরের গভীর থেকে উঠে আসা এক কবি তুষার; অজয় নাগের কথাতে,- আমার জানা নেই-কোন কবি তুষার রায়ের মতো মৃত্যু-জলে নিজস্ব শব্দ ধুয়ে রচনা করেছেন কবিতা। কবিজীবন। তুষার রায়ের শরীর ও আচরনের প্রতিটা অভিঘাত মৃত্যুর প্রামান্য প্রতিমায় তীক্ষ্ণ চোখ ফুটিয়ে দেয়। যা আমাদের ভীত ও আলোকিত করে একই সঙ্গে। ভীত হওয়ার কারন মানবজাতির সমাজ অনুশাসন বিধিবাধ্যতা ও কবির প্রতি ভালোবাসা(নাকি দয়া!) ; আলোকিত হওয়ার কারন কবির শাব্দিক দৃঢ়তায় নিজস্ব পথ-খননের-বিশ্বাস-নিষ্ঠা ।তুষার রায় তার সমসময়ে কতটা উপযোগী সে সম্পর্কে কালচক্রের আর্বতে ভিন্নমত স্বাভাবিক, কিন্তু তার এই নাতিদীর্ঘ অনুশাসনহীন প্রলাপক্রান্ত মায়াময় তরুন বিবাগী কবিজীবন ভাঙা মাঠেও হেঁটে যায় দুর্দম কয়েদীর কল্পনা নিয়ে , সে যেন ফের গজাবেই ফের বিক্ষোভকারী হবে ফের সব কিছু ভেঙে ,দুঃখকে শিশি ভাঙা গদের আঠার মত ফেলে দিয়ে অজস্র স্পাইরাল সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসবে নিষিদ্ধ কারাগারে যার দীর্ঘ লাফ আমরা হয়ত লক্ষ্য করব না অথবা নিকেল খসিয়ে নগরী উড়বে তারই প্রিয় ফানুসে।কোনো এক গোপন জবাবদিহিতে আমরাও কি হয়ে উঠব এক একজন সন্দীপন!ঘুমের মধ্যে মাথার একটি শিরা ছিঁড়ে গেলে অন্ধবুকে লিখে রাখব- তারপর সারাদিন আর কিছু আসে না।রাতে আসে তুষার। মধ্যরাতে বেল বেজে যেতে থাকে অবিশ্বাস্য একটানা। মানুষে এভাবেও বেল দেয়?...দরজা হা হা খোলা। দরোজার ফ্রেমে তালু উলটে লিকলিকে দু হাত কাঁধের দুপাশে ছড়িয়ে দিয়ে অজানা দেবমূর্তির মতো সে দাঁড়িয়ে। দু হাতে দুটি ভারি পাথরের চাঁই । গায়ে চিকনের কাজ করা গুরু পাঞ্জাবি।ব্যস, আর কিছু নেই। ………পুরুষ শীতলা ?

শুধুই তুষার ঝরছে

সকলেই নেমে যায় নীচে বিখ্যাত পাকদণ্ডী রেলপথ বেয়ে
শীতের মেঘলা দিনে ছেড়ে দার্জিলিং
কোলাহল শান্ত, শুধু গোম্ফার ডং ডিং ঘন্টাধ্বনি বাজে
আর তুহিন বাতাসে ভাসে তুষার ও হিম, সুরেখা
আমি ও নিখিল শুধু রহে গেছি মুনলাইট গ্রোভে
স্টোভে শুধু কেটলির সোঁ সোঁ শব্দ নীলগিরি কফি
টেবিলে স্টিল লাইফ ওল্ড মঙ্ক রামের বোতল
ফায়ার প্লেসের কাঁপা কাঠের আগুনে কাঁপছে
                             হাইলাইট বোতল  ও গ্লাস
সাপঘুম ইচ্ছে করে দীর্ঘবেলা ধরে, চলো তবে
পরস্পর তিনজনে শুই- আমি ও নিখিলের মধ্যে
স্যান্ডউইচ সুরেখা সান্যাল
এরকমই শর্ত ছিল আমাদের- আছে , বা থাকবে
ঘুমের ভেতরে হবে বৃষ্টিপাত, তুষার ঝরবে ফার
পাইনের বনের ওপর- তুহিন শীতের রাত ক্রমান্বয়ে
                                      আরো হিম হবে, আর
আচম্ববিতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখি কেউ নেই নিখিল বা
                                     সুরেখা সান্যাল , শুধু জং
বাহাদুর কফির পেয়ালা হাতে, আর ডিং ডং
ঘণ্টার শব্দ শুধু ভেসে আসছে তিব্বতী গোম্ফার,
ব্যস আর কেউ নেই, কিছু নেই শুধুই তুষার, শুধু
ধূ ধূ প্রান্তরে বনের কেবলই তুষার ঝরছে, শুধুই তুষার


দেখে নেবেন

বিদায় বন্ধুগন, গনগনে আঁচের মধ্যে
শুয়ে এই শিখার রুমাল নাড়া নিভে গেলে
ছাই ঘেঁটে দেখে নেবেন পাপ ছিল কিনা ।

এখন আমার কোন কষ্ট নেই, কেননা আমি
জেনে গিয়েছি দেহ মানে কিছু অনিবার্য পরম্পরা
দেহ কখনো প্রদীপ সলতে ঠাকুর ঘর
তবু তোমরা বিশ্বাস করো নি
বার বার বুক চিরে দেখিয়েছি প্রেম, বার বার
পেশী অ্যানাটমী শিরাতন্তু দেখাতে মশায়
আমি গেঞ্জি খোলার মতো খুলেছি চামড়া
                     নিজেই শরীর থেকে টেনে
তারপর হার মেনে বিদায় বন্ধুগন,
গনগনে আঁচের মধ্যে শুয়ে এই শিখার
                              রুমাল নাড়ছি
নিভে গেলে ছাই ঘেঁটে দেখে নেবেন
                           পাপ ছিল কিনা ।





কবিতাই ক্রমশ

কবিতা লিখতে আজকাল প্রথমাংশ থেকেই ভয়,-
কেননা প্রত্যেকটা লাইন পংক্তি আপনি ভাঙছে বিভাজনে
অনুঘটন ও সমান তালে শক্তির যেন শ্যাফট খুলে যাচ্ছে
কবিতা নিয়ে শেষ পর্যন্ত ব্যাপার দাঁড়াচ্ছে বিস্ফোরকের হাতল
আকর্ণ আতা দাঁত বের করে রোমান্টিক হতে গেলে
                                           দন্ত পংক্তি ঝরে যাচ্ছে
নেশা জমাতে গেলেই কবিতা ব্যুমেরাং যেন অস্ত্র, কিংবা
সোনা সাফ করতে এ্যাসিড যেমন মারাত্মক ধোঁয়া বেরোয়
যেন দেহ গান ঘ্রান রক্তমাংসে পুড়ে উঠছে ধোঁয়া এমন
                                                 সিপিয়া রঙ তার,
কবিতাই ক্রমশ গঙ্গার মতো সাফ করছে ময়লা কালো,
ঝুল যত ফেঁশো পাট কাটি, কবিতাই তখন গঙ্গার মতো
                                     তর্পন করাচ্ছে তীরে এবং
ডুব দিয়ে উঠলেই মনে হচ্ছে মন্দির দেখবো সামনে, কিন্তু
চোখ খুলতেই ঝলসে উঠল মড়ার পেটে কাক যাচ্ছে ভেসে এবং
ড্রেজার ঝন ঝন বেজে কাজ চলেছে ভড় নৌকো খড়ের গাদায়
                                                রণরণ করছে রোদ
আবার ডুবছি ভয়ে ভাবছি এবার মাথা ভাসালেই
দেখতে পাবো নিজের শরীর ভেসে যাচ্ছে, সোনা গলান
রোদ ফুটেছে সিপিয়া রঙ গঙ্গা যেন এ্যাসিড হয়ে ফুটে উঠেছে
গাঢ় বাদামী বিষাদ ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে ব্রিজ।

ব্যাণ্ডমাস্টার

আমি অঙ্ক কষতে পারি ম্যাজিক
                  লুকিয়ে চক ও ডাস্টার
কেননা ভারি ধুন্ধুমার ট্রাম্পেটবাদক ব্যাণ্ডমাস্টার,
তখন প্রোগ্রাম হয়নি শুরু- সারা টেম্পল নাম্নী ক্যাবারিনা
তখন এমনি বসে ডায়াসের কোণে,

আমি ড্রামে কাঠি দেওয়ামাত্র ওর শরীর ওঠে দুলে,
ড্রিরি- ড্রাঁও স্ট্রোকেতে দেখি বন্যা জাগে চুলে,
তিন নম্বর স্ট্রোকের সঙ্গে নিতম্বতে ঢেউ
চার নম্বর স্ট্রোকেতে ঝঞ্ঝা ওঠে গাউনের ফীলে,
নম্বর পাঁচে শরীর আলগা, বুকের বাঁধন ঢিলে,
আম তখন ড্রাম বাজিয়ে নাচাই ওকে
মারি এবং বাঁচাই ওকে,
                       ড্রামের কাঠির স্ট্রোকে স্ট্রোকে
যেন গালাই , এবং ঢালাই করি
                               শক্ত ধাতু নরম করার কাস্টার,
কেননা ভারি ধুন্ধুমার ট্রাম্পেট বাদক গ্র্যাণ্ডমাস্টার,
আবার বাজাই যখন স্যাক্স চেলো
ক্যাবারিনার এলোমেলো
                              ডিভাইস এ দ্বন্ধ এলো
আমার বাঁশির সুরের সুতোয়
                            দেহের ফুলে মালা
ট্রা রালা লি রালা লা
ঠিক চাবি হাতে দেখি খুলে যায় তালা।

আমি বাঘ

আপনাদের পোষা বেড়াল বাচ্ছাদের সঙ্গে বাড়তে বাড়তে
মিউ মিউ ডাকের মধ্যে গর্জন করে উঠেছি
হলুদ শরীরে ক্রমশ স্পষ্ট কালো রেখাগুলোই বলে দিচ্ছে-
তুমি বেড়াল নও, তুমি বাঘ,
ট্রাপিজ ও ক্লাউনদের খেলা শেষে জাল ঢাকা এরেনায়
আমি আমার অসম্ভব রাগ ও রোয়াব নিয়ে গর্জন করবো,
আর তোমার চাবুকে ও শক-এ
                                         নিয়ন্ত্রিত খেলা দেখাব
তোমাকেই শুধু মানবো রিংমাস্টার।




চাবি

প্রতিটি তালার কাছে আপন চাবির কথা ভাবি
প্রতিটি পাতায় যেন আশা করা মহৎ কবিতা
এভাবেই ভালোবাসা প্রতিটি পাথর ছুঁয়ে ছুঁয়ে
চালভূঁয়ে এরকমই মেনে যেতে যেতে তুমি
রহস্যের কোন গূঢ় কথা বলেছিলে- তবু দেখি
প্রতিটি শিকল আজও অটুটই আছে, আর
প্রত্যেক বিকেল রোজ নিকেল কে মুছে দিন
ডুবে যায় সন্ধ্যার বাদামি আঁধারে- দেখি
তখন বাঁ ধারে কিংবা ডানদিকে কোনো
দরোজা কি আছে কিনা ভাবতে ভাবতে আমি
প্রতিটি তালার কাছে আপন চাবির কথা ভাবি ।
 গোধূলি

কেই বা আগেতে ছিলো কেই বা পিছনে
এসব প্রশ্ন যতো অবাস্তব ভেবে
                চির  পাইনের সারি
                       পাতায় পাতায় শুনে হেসে ওঠে

হাওয়া, হাওয়া ওঠে ঘুলিয়ে উঠেছে লাল ধূলো
পূবের হাওয়ায় দূর ধান ক্ষেতে মহিষ ও গরুগুলো
                এরকমই উজ্জ্বল বিকেলে ভাবে
                        খোল ভূষি খড় মাথা গন্ধের বাথান

অথবা সে গভীর দুপুরে নেমে গহীন সে ঝিলে
নাকি ভাসিয়ে আধো হাওয়া জলের মধ্যে নাকি
মহিষ দেখতে পায় গভীর মহিষ নাকি সেইখানে
ভূত, ভয় পেয়ে ছুটে চলে আসে
                       ফিরে আসে গরু মোষ এই পথ

লাল ধূলো মিশে যায় মহিষের গায়ের রঙের
                              মতো গাঢ় সন্ধ্যায়।


আনুপুঙ্খ

আমি আর আনুপুঙ্খে যেতে চাই না ইদানীং
আমি একটু স্বাদ ও সম্পৃক্তির মধ্যবর্তী শর্টওয়েভে
কেন্দ্র থেকে কেন্দ্রাতিগ মূর্তি থেকে বিমূর্তনে

এই নীল লাল ও হলুদ তাপ সংবহনে
পরস্পরা নিয়তই ভেঙে ভেঙে ত্রিডবল
ছয়গুন, বারো ও চল্লিশ থেকে লাফ
                                       দিতে ক্রমশই

আরোহাবরোহনের নঙর্থক হৃদি

যদিদং হৃদয়ং বলতে ফেটে যাব
লাল নীল হলুদের থেকে ইনফ্রারেডে

এ কথায় কেমন বোঝানো গেল সেই
                                   রাগত সংশ্লেষ
এই ট্রেন থেকে আমি অতএব নেমে
চলে যাব বনান্তরে- ক্রমশ গভীর ওই বনে
গিয়ে ওই বাঘিনীর রোমশ শরীর
                                   মেখে শোবো।







হাসপাতালের কবিতা
-১-

হাসপাতাল ভালো লাগে না।
ডেটল ওষুধ হাওয়াকে আসতে দেয় না।
সিস্টার ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে দিন,
বাইরে থেকে ঘুরে আসব-
খুব দূরে নয় নদীর কাছে- কাছাকাছি
চলাচলের রাস্তার পাশে
প্রতিদিন যেখানে মানুষেরা কাঁদে হাসে
সেতুর ওপর ছায়া- সান্ত্বনা
তার তলায় আমি কিছুক্ষন বসব
সিস্টার আমায় নিয়ে যান
যেখানে দিনের শুরু।

হাসপাতালের কবিতা
-৩-

রাত্রি গভীর হয়ে আসে
রাত্রি ভারী হয়ে আসে চোখের পাতায়।
রাত্রি কী কালো
এমন কালো রাত্রি দেখিনি কোনো দিন।
সিস্টার, সব আলো জ্বেলে রাখুন
এখন আমি ঘুমাব।
আবার কবিতা লিখব
নতুন কবিতা
একটা কবিতা লেখার আগে
                        কিছুক্ষন ঘুমাব।
আবার কবিতা লিখব
পুরোনো কবিতা শেষ হলে।

হাসপাতালের কবিতা
-৭-

মাঝে মাঝে উদাসীন খুব সারাদিন
মাঝে মাঝে অভিমানী রাগ হয়
                            মৃত্যুর ওপর
আসছি এখনি বলে চলে গেছে সে ঘুর পথে

বসে বসে বেলা যায় তার রেখে যাওয়া
                             ছাতার তলায়
একদিন আসবে রাতে
যখন থাকবো গভীর ঘুমে।



হাসপাতালের কবিতা
-১০-

এইবার গোড়া থেকে শুরু করব জীবন
এইবার জীবনকে পাটে পাটে সাজাব
অনেকদিন তার দিকে ফিরে দেখিনি
তার বায়নাক্কার পাত্তা দিইনি
                  তাচ্ছিল্য করেছি অনেক
চোখের জলের দাগ মুছিয়ে দিইনি
তাই তার এই প্রতিশোধ-
একা একা দিন গোনা
এইবার জীবনকে অতি সযত্নে সাজাব
                ঘুম-হাসপাতালের থেকে বেরিয়ে
আমাকে আরো একবার সুযোগ দাও হে নাথ।


গতি

এক অদ্ভুত আচ্ছন্ন অবস্থার মধ্যে হঠাৎ হরিণ
তড়াং লাফিয়ে গেলে নিঃসঙ্গ চোখের সামনে
খুলে যায় প্রত্যেক জানলা-
                     সিঁড়ির পর সিঁড়ি
বিপরীতে তীব্র ছোটে বিমানের
                     তলায় রানওয়ে
সেইখানে তবে পৌঁছনো যাবে ভাবতে বুক
বুকের মধ্যে যন্ত্রপাতি রোম কূপে কূপে
আনন্দের তেলঘাম বেরিয়ে আসে দেখি

এইবার

গুড়ি মেরে বসে থাকার মতো এতোদিন
                                 হেঁটেছি জীবন
এইবার, এইবার ফিটফাট লাফ দেবো ভাবি
ঝাঁ চকচকে শরীরে, ভঙ্গিতে ঠিকঠাক এইবার

সব চাকা যায়, ফিরে আসে ফের আমি
ত্রিকোন সাধের দিকে চেয়ে বলি ফেরো
নয়তো স্থির থাকো মধ্যযামে চাঁদমারী
হে জীবন, গুড়ি মেরে এতোদিন থেকেছি বসে
এইবার, এইবার ফিটফাট লাফ দেবো ভাবি

গম্ভীর চেয়ারে বসে, আঙুলে কফির কাপ
সামনের জানলায় প্রেশারকুকারের শোঁ শুনতে
গুনতে সাত পাঁচ আঠারো বাইশ এইবার
উনুন উলটে কেটলির মতো উত্তাপে শাসিয়ে
পৃথিবীকে হাসিয়ে ভালোবাসিয়ে নেবো আমি।



ভালোবাসা ঃ দুই

আমায় অপমান করে যে লোকটা
             তাকেও আমি ভালোবাসি
এ ভাবেই ভালোবাসতে বাসতে
অপমান করি নিজেকে, তোমাকে , এবং
             ভালোবাসাকে
এ ভাবেই ভালোবাসা পেয়ে যায়
ভুলভাল শত্রুমিত্র থেকে
             শূন্য কলসী এবং ঘুঘু
যে লোকটা কাঠের ক্রুশ তৈরি করছে
অথবা যারা বানাচ্ছে পেরেক আমার জন্য
তাদের দিকে তাকিয়ে জানতে পারি
আমিই সেই যিশু কিংবা কালোবাজারী
যাকে ঝোলানো হবে নিকটবর্তী ল্যাম্পপোস্টে

তখন আমি ভালোবাসতে শুরু করি ল্যাম্পপোস্টকেও ।





********************************