66Th pOsT : মণীন্দ্র গুপ্ত



........মনীন্দ্র গুপ্ত.......



(কাব্যগ্রন্থ- নীল পাথরের আকাশ, আমার রাত্রি, মৌপোকাদের গ্রাম, লাল স্কুলবাড়ি, ছত্রপলাশ চৈত্যে দিনশেষ , শরৎমেঘ ও কাশফুলের বন্ধু, নমেরু মানে রুদ্রাক্ষ, টুংটাং শব্দ নিঃশব্দ , বনে আজ কনচের্টো, মৌচুষি যায় ছাদনাতলায়, এক শিশি গন্ধহীন ফ্রেইগ্রানস, নিরক্ষর আকবর...)


                                আপনার কবিতা লেখার সূচনা সম্পর্কে বলুন- শিলীন্দ্র ৯৪ সংখ্যায় কমল মুখোপাধ্যায়ের এমনই প্রশ্নের উত্তরে মনীন্দ্র গুপ্ত বলেছিলেন- একজন দোয়েল কবে গান গাইতে শুরু করেছিল? একজন উদবেরাল কবে সাঁতার কাটতে শুরু করল? একজন মৌমাছি কবে কেমন করে চাক বাঁধতে শিখল?এসব প্রশ্নের উত্তর কি তারা দিতে পারবে?  মনে পড়ে চেতনা জাগার পর থেকেই নির্সগ আমাকে দারুন মুগ্ধ করত। নির্সগের সৌন্দর্য আমি অনুভব করতে পারতাম- মন কেমন করত- মন আঁকুবাঁকু করত। সেই পলায়মান সৌন্দর্যকে আমি মন দিয়ে ধরে রাখতে চাইতাম। অপরিচিত অর্ধপরিচিত যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধার মুখ ও আকৃতি আমি বিস্ময়ের সঙ্গে নিরীক্ষন করতাম। তাদের ঐ বাইরের খোলস, নড়াচড়ার ভঙ্গি দেখে দেখে ক্রমশ আভাস পেতাম  তাদের জীবনের, রহস্যের। ক্রমশ বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জন্ম, মৃত্যু, সময়, মহাকাশ নিয়ে নানা দার্শনিক চিন্তা মাথায় ঢুকল। এই সময় আমার মনে হত , আমি হয়ত চিত্রকর এবং ভাবুক। একসময় আর পাঁচটা ছেলের মতো লিবিডো আমার মধ্যে প্রবল হয়ে উঠল। হতে পারে, তারই তাড়নায় আমার কবিতায় মনোনিবেশ। অন্তত আমার প্রথম বই আমরা তিনজন সেই কথাই বলে। তারপর একদিন লিবিডো আমাকে দংশন করল। বিষ টেনে নেবার জন্য  এই সময় কবিতাই বিষপাথরের কাজ করেছিল। ক্রমে কবিতাই আমার পরম আশ্রয় হল।.....

                       মনীন্দ্র গুপ্তের বহুমাত্রিক দ্বৈত অদ্বৈততায় পৌঁছতে গেলে , তার ন্যারেটিভস এর রাপচারগুলিকে স্পর্শ চিহ্নে গাঁথতে গেলে , বৃহত্তর বুননের, ডায়মেনশানের একটা শুরুর দিকে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু বাংলা কবিতার অনুগত দশকীভাগে তার আয়োজনতো স্বেচ্ছানির্মিত! আঙ্গিক থেকে স্বরায়ন, ব্যক্তি প্রতিবিম্বে বহুস্বরিক তাত্ত্বিকতায় তিনি যেন নিজেই এক গতিময় রেখা, এক রহস্যময় রং । দশকচিহ্নিতহীন কবিতার পিঠে চেপে শিবপিথেকাস, রামপিথেকাস, পিকিং মানুষের ফেলে দেওয়া ভাঙা হাঁড়ি-সরার খেলাঘর গুছিয়ে ত্রিমাত্রিক চেতনায় মেতেছে তাঁর অনতিক্রম স্বতন্ত্র । প্রকৃত অর্থে তিনি এক পরিব্রাজক। যাত্রার মধ্যে সীমার মধ্যে নির্বাচনগুলির মধ্যে শতশরতের আয়ু নেওয়া অক্ষর পুরুষ। তাকে কিভাবে ভাবব ! চল্লিশের কবি? পঞ্চাশের কবি? ষাটের কবি? নাকি ২০১১ তেও বর্ষীয়ান কবির নবতম সংযোজন নিরক্ষর আকবরে তার যোজন যোজন বীতস্বপ্ন এক অনাস্বাদিত চলাচলের কথা, এক সাহজিক অভিযাত্রার কথাই চিনিয়ে যায় কথনবয়নের মনীন্দ্র কে!- দুঃখ বা শোকের মত ভারী কিছু না এই মসলিন/ আমার ভাঙা গাল, ছেতরে যাওয়া ঠোঁটকে/ ঢেকে রেখেছে সাদা উড়ন্ত দাড়িগোঁফ/ সেও যেন মসলিন/.......এবার যেন একটু আগেভাগেই/শীতের দেশ থেকে বক সারস আর হাঁসেরা এসে নামছে বিলে/ আমাদের, আশি বছরের বৃদ্ধদের, প্রেম ক্ষুধা শোক ও ভ্রান্তির পাশে/ পক্ষীজীবনের কয়েকটা রাত কাটাবার জন্য...( বুড়োদের সঙ্গে পাখিদের )। তাঁর কোলাহলহীন অবিশ্রাম স্থিতিবিন্যাসের পাশে, পাহাড়প্রমান মনঃসংকলনের পাশে এসে দাঁড়ালে মনে হয় অসংখ্য সাদা ফুল, অসংখ্য ভিজ়ে মাটি , অনন্ত ফেরিওয়ালার ক্ষীন গলিপথ ধরে ফেরা আর ফিরে দেখার এক অসমীকরন নিয়ে চিরসত্যের দিকে চলেছেন, চলেছেন নির্বিকার সম্ভারের দিকে। খড়কুটো-মরা-পাতা অতীন্দ্রীয় ঋতুচক্রের ভেতর লুকিয়ে রেখেছেন নিজের পথ নিজের অনুভাবিত ভাঁটফুলগুলি। উতরোল সমুদ্র জীবনে গোলাপি পায়ের পাতা হাঁসের মতই বট পাকুড়ের ব্যাপারী হয়ে কোথাও শূন্য থেকে লাফিয়ে নেমেছেন শ্রমনে আবার কখনও শূন্যের উন্মুক্তিতেই ভাঙা জানলার ছবি আঁকতে আঁকতে দৃশ্য সাদৃশ্যে কবিতামন্থনে শেকড় বাকড় চারিয়ে বিস্ময় থেকে বিযুক্তি থেকে একীভূত পরিনামে স্রষ্টাকে পেরিয়ে যাচ্ছে তার অলখ অনুগত যাত্রা।

পথনির্দেশিকায় তিনি চেয়েছেন পূর্ননির্মান। অকলুষ সমগ্রতা। নিজের কাছে নিজের সম্বোধনের কাছে নিজের জন্মান্তরের কাছে নাছোড়বান্দা এক পথিকের পথপ্রাননা । যেন স্মৃতির একান্ত থেকে সংসারী সারসংকলনের উপাদানগুলি থেকে , ঢেঁকিশাক গাবগাছ আর বেতফলের প্রাগৌতিহাসিক স্থাপত্যগুলি থেকে বর্ষীয়ান কবি শব্দের বিমোহন কুড়িয়ে পৃথিবীর ভাষা কুড়িয়ে উত্তরাধিকার দান করেছেন পরম্পরার পাঠককে । সব নিয়ে মনীন্দ্র গুপ্ত । শিউলি ফুলের ফুটো দিয়ে বেরোলেই পাওয়া যাবে সাদা মেঘের দেশ আর স্বর্নচাঁপার ফুটো দিয়ে বেরোলেই মুনশীবাড়ি। আবার জ্যোৎস্নায় ফোটা হাস্নুহানা ফুলের সুক্ষ পথটূকু পেরোলেই ঝাড়লন্ঠন নিবে আসা এক চাঁদনী জলসার দেশ। হাটখোলা পৃথিবীর দ্বন্ধ, নিরাময় , খন্ড খন্ড ধ্যাননিবিড় ডায়ভারসিটির মধ্যেই যেন মনীন্দ্রগুপ্তের কল্পকলোনী। তার কবিতাকে , তার অনির্দেশ চিত্তবৃত্তিকে জানতে হলে আমাদের ফিরে আসতে হবে এই নৈসর্গিক গুটিপোকাদের কাছে, আঁকড়ে ধরতে হবে মাটি, পাহাড়ের পরিচর্যাকে।প্রাকৃতিক বিশুদ্ধতার তুবড়ে টোল খেয়ে যাওয়া জীবনমিতির মাঝেই পরবাসী কুড়ানীর মতো মধ্যবর্তী বৈভবগুলোকে সামিল করে নিতে হবে তাদেরই গন্ধসলিলে। এই স্পিরিচ্যুয়াল রিনিউশনেই যে বৌদ্ধ শ্রমনের মত তিনখানা কাপড়, একটি ভিক্ষাপাত্র, একটি ছোটো কুড়ুল, একটি ছুঁচ, একটি কটিবন্ধ ও একটুকরো জল ছাঁকার ন্যাকড়া নিয়ে কবিতার সংখ্যাতত্ত্বের থেকে মনীন্দ্রগুপ্ত পাড়ি দিচ্ছেন সহজিয়ার দিকে.............



বিধবা

তুলোর বালিশ অনেকদিন নেই, সোঁদালের ফুল রোদে শুকিয়ে
খোলে ভরে নিয়েছি।
সেই বালিশে শুয়ে দুপুরে তন্দ্রা মতো এল।
তন্দ্রার মধ্যে চিন্তা জড়িয়ে ওঠে
যেন তেপান্তরের মাঠে কাঁকুড়লতা আলগা মাটি ধরে ধরে এগোচ্ছে।
শাশুড়িমা যেন এখনও বেঁচে আছেন-
ধান সেদ্ধ করার সময় যেমন বলতেন, ডানের মতো, তেমনি যেন বলছেন-
এই ধান সব জ্যান্ত, অমর।
এইবার গরম জলে সেদ্ধ হয়ে মরবে ।
মরা জিনিস ছাড়া মোদের মুখে কিছু রোচে না।
বালিশের সোঁদাল ফুল-বীজ জ্যান্ত। তন্দ্রার মধ্যে শিকড় চারিয়ে
আমার চারপাশে ঝটপট গাছ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
মাথায় ঘন হয়ে ধরল ছায়া। সেই সোনা-হলদে ফুল
ফুটে উঠল স্তবকে স্তবকে, ঝরে পড়তে থাকল
বিছানায় , আমার গায়ে।

জেগে উঠে দেখি, সন্ধ্যা উতরে গেছে। কোথায় কে!
স্বামীপুত খেয়ে বসে আছি।
অনাথা বিধবা। জ্যান্ত মরা সবই খাই।



বিড়ালী

বেড়ালটা সকাল থেকে কাঁদছে
কাল থেকে ওর বাচ্চাটা নিখোঁজ।
আমি রাতের বেলা রামকৃষ্ণ কথামৃত পাঠ করছিলাম,
সে শান্তির আশায় এসে দুই থাবা জোড় করে বসল।
কিন্তু হল না।
একটু পরেই সে মিউমিউ করে আবার কাঁদতে লাগল,
পাগলের মতো প্রদক্ষিন করে ঘুরতে লাগল।
আর পুত্রশোক আগুনের মতো ঘিরে ধরল
                                            রামকৃষ্ণদেবকে।



গড়িয়ার মোড়ে

শহরতলি শেষ হয়ে যেখানে গড়িয়াগ্রামের শুরু
সেখানে বহুকালের একটি বেশ্যাপাড়া আছে ।
বেশ্যাদের সঙ্গে গলির একটা প্রাচীন সম্পর্ক,
অতএব সেই পাড়ার দুটো গলির মুখে
দিনরাত কয়েকটা মোড়া পড়ে থাকে,
সেইখানে ঐ মেয়েরা এসে বসে, অপেক্ষা করে।

গড়িয়াগ্রামে কয়েকটা অতি পুরনো ছোট পুকুর আছে।
চারপাশ থেকে গাছপালা ঝুঁকে পড়েছে,
অ্যানোডাইজড ধাতুপাতের মতো ধূসর পাঁশুটে জল-
অদ্ভুত সেই পুকুরগুলো ঘোর তামসিকতায় আচ্ছন্ন ।

ঐ পুকুরগুলির ঘাটে যেমন চ্যাং বা চ্যাপটামুখ গজাল মাছেরা এসে
খাদ্যের খোঁজে মুখ তোলে, মেয়েগুলো ঠিক তেমনি ঐ গলির মুখে
তাদের ঘোলাটে শরীর নিয়ে চারপাঁচজন করে আসে,
তাদের চ্যাং গজালের মতো মুখগুলো তুলে
খাবার খোঁজে।



চিমটে

ডাক্তারের চক্ষুষ্মান চিমটে তাড়া করেছে
আর অন্ধ ভ্রুন মায়ের ফ্লুইডে পিছু সরে সরে
কেবলই পালাতে চাইছে।

মায়ের ফ্লুইড! ভেবেছিলাম সেটা বুঝি ডংকাপেটা নিরাপদ আশ্রয়।
কিন্তু সেখানেও কেউ কারো না- আমার যমজ ভ্রুনটাও
আমার কেউ না। আমি ওকে সামনে ঠেলে দিয়ে
পিছনে পালাতে চাইছি।
আমাদের ঘিরে আছে মায়ের একটা খোলস-
সেই বিবৃত শ্লথ দেহ শীতের দুপুর ভরে তেলের আচার খায়,
চেটে চেটে পোড়া মাটি খায়, - তার চোখে আবেশ।

ঐ নির্বোধ গাভিন আবেশই বুঝি মাতৃত্ব !
আজ কত সহযে ঐ মাতৃত্ব ছিঁড়ে, গর্ভে ঢুকেছে
চক্ষুষ্মান চিমটে-
পালাতে পালাতে ভ্রুন শেষদেয়ালে এসে ঠেকেছে।

খসড়া বিজ্ঞাপন


আমি মেরী স্টোপস নার্সিং হোমের কর্ণধার। এখানে গর্ভপাতের পরামর্শ ও সাহায্য দেওয়া হয়। আগে আমার চিমটে কয়েক সপ্তাহের ভ্রুনটিকে যখন ধরতে চেষ্টা করত সে কেবল মায়ের গর্ভের ফ্লুইডে এঁকেবেঁকে পিছনে সরে পালাতে চাইত। এখন সাকশন পদ্ধতিতে আর তার রক্ষা নেই। দুমড়েমুচড়ে সে বেরিয়ে আসে। সমুদ্রের পাড়ে ঢেউয়ের ছিটকে আসা জেলিমাছের মতো সে পড়ে থাকে।





বাড়ি


আমি পারি না। কিন্তু তোমরা প্রত্যেকটি পরিবার বাড়ি তৈরি করো-
আনন্দময় বাড়ী।
আমি প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা প্ল্যান করে দেব,
নিজে দেখাশোনা করে বানিয়ে দেব।
গোনাগুনতি খোলা সিঁড়ি ছাদে উঠে গেছে এমনভাবে যেন শিশুরা
মনে করবে তারা আকাশে উঠছে। বাজপাখি দুপুর-মৌতাতে
পাহাড়চূড়া ভেবে জলের ট্যাংকে এসে বসবে। আবার ঝড়ের মধ্যে
মনে হবে। কংক্রিটের এক বেঁটে পালোয়ান চার হাত-পায়ে
উবু হয়ে মাটি আঁকড়ে ধরেছে, প্রতিদ্বন্ধী কিছুতেই তাকে চিত
করতে পারছে না।
ফার্নিচারও আমি ডিজাইন করে দেব, আপহোলস্টারি পছন্দ করে
দেব।
ধূসর-সবুজ জলের মধ্যে তন্বঙ্গী সরলপুঁটি যেমন ঝিকমিক করে
তেমনি, ছায়াছন্ন ঘরে তোমাদের কিশোরী মেয়েটিকে মাঝে মাঝে
দেখা যায়- কাজ করছে, বই পড়ছে। দিনশেষে বাড়ি ফিরে
নিজের কৌচটিতে বসে বলিষ্ঠ রুইমাছের মতো তুমি শান্তি
পেতে পেতে দেখবে, মৃদু আলোয় তোমার চারপাশে
জলজ কুসুমেরা দুলছে।
আমার নিজের বাড়ি কেমন হবে সে কথা ভাববার সময়
আজ পেরিয়ে গেছে।





এখন ওসব কথা থাক

এক লক্ষ বছর সঙ্গে থাকার পর সাব্যস্ত হবে, তুমি আমার কি না।
ওসব কথা এখন থাক।
এখন চলো মিকির পাহাড়ে বুনো কুল পেকেছে,
                                                        চলো খেয়ে আসি ।
লাল রুখু চুল
         সূর্যাস্তের মধ্যে
               অর্কিডের উজ্জ্বল শিকড়ের মতো উড়ছে।
                       -দেখি দেখি, তোমার তামাটে মুখখানা দেখি।

সূর্য এখনি অস্ত যাবে। পশুর মতো ক্ষীন শরীরে
আমরা হাঁটু পর্যন্ত জলস্রোত পেরিয়ে চলেছি-
                      জলস্রোত ক্রমশ তীব্র..........কনকনে......



অলাতচক্র

মারা যাবার পরে সে রাস্তা চিনতে পারছিল না।
থতমত খেয়ে সে পারকিনসনের রোগীর মতো
স্পাইরাল সিঁড়ি বেয়ে যেখানে এসে নামল
সে জায়গাটা গ্র্যাণ্ড হোটেলের পিছনের সরু উঠোণ-
ধোবিখানার সাবানজলের দিন রাত ভেজা আর
পাম্পঘরের আরশোলার বাসা, লুব্রিক্যান্টে পিছল অন্ধকার,
সদ্য ছড়ানো ব্লিচিং পাউডারের গন্ধ ।
তার মনে হল, নরকভোগের পক্ষে এই জায়গাটাই প্রশস্ত।

হাজত থেকে বার করে আসামীকে যেমন কোর্টে তোলে
তেমনি তাকে প্রায়ই হোটেলের একটি ছায়াময় কক্ষে পাঠানো হয়।
সেখানে এক কিশোরী পরিচারিকা কার্পেটে বসে
একা একা দিনরাত টিভি দ্যাখে। বীনাবাদিকাদের চেয়ে
টিভি-দেখা পরিচারিকারাই বেশ স্ফুরাধরা।
আয়ত কৌচে এলিয়ে বসে সে দাসীটিকে দেখতে থাকে
আর তার পূন্যভোগ ফিল্মের রীলের মতো মৃদু কিরকির শব্দে গুটোয়।
পাঁচ হাজার বছরের পিরামিডের মৌন ক্রমশ চর্তুদিকে ঘনিয়ে আসে।



অসীমবাবুর গল্প

শ্রাদ্ধ শেষ হতে হতে দুপুর গড়িয়ে গেল বিকেলে-
সন্ধ্যার মুখে অসীমবাবুর পিণ্ড আর খাআবার
নন্দ লেকের জলে দিয়ে এল।
লেকের ওইখানটায় কেউ বড় একটা যায় না।
জলে দলঘাস গজিয়েছে, কচি নলখাগড়া গজিয়েছে,
জলের নিচে শৈবাল।
বিদেহ অসীমবাবু যেন জানতেন- ওইখানেই গাছতলায়
বিমর্ষ আর ক্ষুর্ধাত হয়ে বসেছিলেন-
নন্দ চলে যেতেই ময়লা প্যান্টের পা গুটিয়ে
পিন্ডি নিতে জলে নামলেন।
পোড়াবার সময় চশমা সঙ্গে দেয় নি,
এখন আর ভালো দেখতে পাচ্ছেন না।
ওদিকে সূর্যের শেষ রশ্মি মিলিয়ে যাচ্ছে-
পিণ্ড কি জলে মিশে গেল?
না কি মাছেরা খেয়ে গেল?
অসীমবাবু অন্ধের মতো তাঁর রোগা হাতে
হাতড়ে হাতড়ে খোঁজেন ।
মাঘের শীত মিশেছে লেকের জলে,
অন্ধকার মিশেছে লেকের জলে।
বড় কষ্ট হয়।
শীত, খিদে, নিঃসঙ্গতা কি এখানেও পিছু পিছু এল?
সামান্য একটু রেঁধে দেওয়া অন্নের জন্য
সারা জীবন এত অপেক্ষা, তিতিক্ষা-
অসীমবাবু শরালের মতো কাঠি-কাঠি পায়ের
রাত্রির মধ্যে ভাতের টুকরো, পোড়া মাছের টুকরো খুঁজতে লাগলেন।

ওঁ ভূঃ ভূঃব স্বঃ ।
শীত অচিরস্থায়ী । দু মাস পরেই বসন্ত এল ।
পরিযায়ী শরালদের সঙ্গেই অসীমবাবু
দুই ডানা মেলে আকাশে উঠলেন।
ওঁ পার্থিব আকাশ ।
ওঁ অপার্থিব আকাশ ।
ওঁ আকাশ।



ঘুঘু

শীতের দিন। আশি বছরের পুরনো ফুসফুস
যেন উমা কর্মকারের তালি দেওয়া হাপর-
নিঃশ্বাস নিই আর ঘুরুর ঘুরুর শব্দ হয়
দুটো ঘুঘু এসে পোড়ো ভিটেয় বসেছে যেন।
নিকোটিনে ঘাস চোরকাঁটা পিঙ্গল-
তাদের উপর রোদ্দুর আর ভাঙা উনুনের ছায়া ।
আমি ঘুরুর ঘুরুর শব্দ শুনি
আর খুব নজর করে দেখি
বুকের মধ্যে ঘুঘু নেমেছে।
ঘু ঘু ঘু ঘু গাছ নিঃশ্বাস ফেলে,
ছায়া পাখির খোলা খাঁচার নকশা, তাল গাছের ছাপ
আর ভাঙা জানলার ছবি আঁকতে আঁকতে
ডান দিকে সরে।

শেষজীবন বড় মিষ্টি।
পোড়ো বাড়িতে ঘুঘু নামে,
হেঁটে বেড়ায়
ডাকে।


ছায়াজগৎ

এই বাড়িতে অনেকদিন হল একা। দুপুরে বই নিয়ে
বসে আছি- বই থেকে মাথা না তুলেও মনে হল
একটা ইঁদুর যেন ঘরের কোনাকুনি দৌড়ে গেল।
আসলে কিছু না।

একদিন হঠাৎ মনে হল একটা স্বচ্ছ কাচের গুলি
চেয়ারের তলা থেকে বেরিয়ে সামনে গড়িয়ে গিয়েই
কোথায় লুকিয়ে পড়ল। আসলে এটাও কিছু না।

পাল্লাবন্ধ কাচের জানলার ওপাশে একটা বড় ছায়া
খসে পড়ল- ছায়া নয়, নিশ্চয় সুপুরি গাছের বালতো।
উঠে জানলা খুলে দেখি, বালতোও না, বিরাট ডানার
একটা চিল পাশের পুকুরে ঝাঁপ দিয়েই নখে মাছ নিয়ে
উঠে যাচ্ছে আকাশে।

দরজা খোলা থাকলে মাঝে মাঝে বেড়াল ঢোকে,
পাশের ফ্ল্যাটের এলসা কুকুরটা ঢোকে। না, না,
বেড়াল কুকুর কেউ না, আজকের কাগজটা হাওয়ায়
মাটিতে পড়ে গড়াচ্ছে আর ফটফট করে কান নাড়াচ্ছে।

বিকেলে লতার ছায়া দোলে দেয়ালে- হঠাৎ মনে হয়
উড়ন্ত প্রজাপতিকে বুঝি টিকটিকি তাড়া করেছে।

সেদিন সন্ধ্যেবেলা চমকে উঠলাম- একটা বাঘ এসে
ঢুকছে ঘরে। না, না, বাঘ নয়, তুমি। লাফিয়ে উঠতে গিয়ে
তাকিয়ে দেখি- নাঃ তুমি না, পৃথিবীর ঠাণ্ডা
সন্ধ্যাবেলাকার ছায়া ঢুকছে ঘরে।



স্বামী -স্ত্রী

এসো, শুতে এসো । একা বিছানায় ভয় করে। অন্ধকারে পাশে থাকো।
পায়ে সায়েটিকার ব্যথা। পায়ের উপর তোমার ভারী জানু চাপিয়ে রাখো।
ঘুম আসে না।
আঙুলে আঙুল জড়িয়ে চাপো, কানের পিছনে হালকা করে ফুঁ দাও ।
ভয় করে। অন্ধকারে পাশে থাকো ।
টাকপড়া মাথা এখনো পাঁচ-দশটা চুল শীতে কুঁকড়ে আছে-
স্তনের তলায়, বুকে চেপে ধরতে ধরতে বলছ শুনতে পাই ;
  আহা, এখনো মাথাটা তলতলে-
     আহা, সাত দিনের শিশুর মতো ব্রম্ভতালু দিপদিপ করছে।
হয়তো ঘুম আসছিল, কিন্তু এই কথা শুনে চোখের কোটরে
                                                মণি স্থির হয়ে গেল ।
কালকে দোল। আজ শুক্লা চতুর্দশী।
চাঁদ সেই গর্তে পাতকুয়োর পুরনো জলে চিকমিক করছিল
তোমার বগলের ফাঁক দিয়ে আমি তাকিয়ে দেখছি।

বিয়ের আংটিটা কুয়োয় ফেলে দাও-
চাঁদের বুকে সেটা কাঁকড়ার ছানার মতো আটকে থাকুক,
কাশের ডাঁটায় বিঁধে বিঁধে দ্রোনের মতো একজন কেউ
একদিন তাকে ঠিক তুলে আনবে।
    এসব কি ভয়-পাওয়াদের রাতের স্বপ্ন? না কি
    ব্রম্ভতালু- দিপদিপ- করা শিশুর দেয়ালা?

পরের বছর
অ্যানাটমি ক্লাসে ফর্মলিন এ চুবনো শবের হাত-পা কাটা হচ্ছে,
নাড়িভুঁড়ি টেনে বার করা হচ্ছে-
ছেলেমেয়েরা চলে গেলে সে টেবিলে শুয়ে ঘুমঘুম গলায় বলছে;
                 খোকা মাকে শুধায় ডেকে
               এলেম আমি কোথা থেকে,
                কোনখানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে।
বলতে বলতে সে একা-ঘরে উঁচু সিলিংয়ের দিকে
তাকিয়ে থাকে, শব্দহীন গলায় ককিয়ে ককিয়ে ডাকে;
                এসো, শুতে এসো
                একা বিছানায় ভয়  করে
                 অন্ধকারে পাশে থাকো।



********************************