যুগান্তর চক্রবর্তী ঃ 58Th pOst

........যুগান্তর চক্রবর্ত্তী.......

নিরর্থ লেখার পাশে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছি
ঘুমিয়ে পড়েছি যেন অবশিষ্ট নষ্ট জীবনের
এইসব লেখা আর না-লেখার নিরর্থকতার
পাশে, মাথা রেখে,- শুধু ঘুমের ভিতর জেগে থাকে
অবশিষ্ট জীবনের লেখা আর না-লেখার
অক্ষমতা সমগ্র আমার

(কাব্যগ্রন্থ- আঘাটার গান, আমার প্রতীক্ষা, আরোগ্যের দিকে যাত্রা, ইষ্টিপত্র, স্মৃতিবিস্মৃতির চেয়ে কিছু বেশি....)



ক্রমজায়মান একটা থাকা। যুগান্তর চক্রবর্ত্তীর কবিতার প্রসঙ্গ এলেই প্রথম এই কথাটাই মনে আসতে পারে। চল্লিশের দশকে যে কবির জন্ম আর যিনি ১৯৫৩ থেকে প্রায় ২০০৫ বিস্তীর্ন সময়াবধি সাজিয়েছেন তার কবিতার নিজনভূমি, তার অন্তঃস্রোতকে এক অর্থে কবিতার কালপ্রবাহকে অতিক্রম করে অনন্ত উদ্ভাসনের দিকে যাওয়াই বলা যেতে পারে। বাংলা সাহিত্যের দু দুটো বিশেষ আন্দোলন কৃত্তিবাস আর হাংরীর সাক্ষী হয়েও তিনি কোথাও তার বিনীত প্রশান্তিগহন নিয়ে স্থির ছিলেন কবিতার চিরায়মান গ্রহনে। সি জি ইয়ং বলেছিলেন eternity where everything is born and everything has already dead. আর যুগান্তর চক্রবর্ত্তী বললেন –“মাথার অপরদিকে কিছু স্পষ্ট নাডাচাড়া/ তুমুল চিকার কোনও নাই/ ..... শরীরে জলের কাজ লেগে থাকে/ পাতা ঝরিবার কাজ/ আলোকবাতাসের মুখে ভেসে ওঠে মুখ....বারবার ভেসে ওঠে ভ্রমনের সেই নিবৃত্ত, যা স্রোতময় যা নিশ্চিত অথচ যা নির্ধারিত নয়। কবিতার খোলনলচে পালটে দেওয়া নয়, সংশোধন নয় , তার কবিতার মুক্তরূপ যেন বারবার প্রসারিত হতে চেয়েছে বোধের আত্মশুদ্ধিতে।

স্মৃতিবিস্মৃতির চেয়ে কিছু বেশী’,’ইষ্টিপত্র ও অন্যান্য ইত্যাদি বইগুলো আজ পাঠকের কাছে স্মৃতিবিস্মৃতির চেয়ে সত্যিই কিছু বেশী নয়। বিক্ষিপ্ত সময়ের কবি হিসেবে বাংলা সাহিত্যে যুগান্তর চক্রবর্ত্তীর এই মান্যতা আদতে বাংলা সাহিত্যের, কবিতার এক অনিঃশেষ ক্ষয়ের কথাই মনে করিয়ে দেয়। চুপিসাড়ে ঝরে গেল দিন,/ কখন যে অন্ধকারে একাকার হয়ে গেল/ বাজনা আলো চেনাপথ অচেনা পথিক/ কখন যে অন্ধকার/ অন্ধকার/ অন্ধকার/ গ্রাস করল তোমাকে আমাকে...যে কল্পকুসুমকে হাতে নিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন যাত্রা, যেন বারবার সেই অনন্তকালীন আবির মাখতেই তার বিস্ময় উসর্গীকৃত হয়েছে কবিতার নিস্তব্ধ উচ্চারনে। বয়স বেড়েছে, বেড়েছে আয়ুর অসুখ-তবু যুগান্তেরর অলীক তোরঙ্গে আজও হয়ত পাওয়া যাবে সেই ছিন্নপত্র সেই ঊর্নাজাল...ভেজানো দরজার বাইরে অবিরাম যাওয়া আসার স্তব্ধতা।

সর্গ

তোমার বুকের জামা তুমি খুলে দেবে নিজ হাতে,
আমি চাই। আমার নশ্বর হাত অন্যত্র রয়েছে।

আমি চাই উসর্গহীন
সব লেখা, সব প্রেরনার আগে তুমি।

তোমার বুকের পরে আজ কোনো অপর কবির
দাবি নাই। সমস্ত নশ্বর হাত অন্যত্র রয়েছে।

আমাদেরও মুখোমুখি শুতে হবে,
              ওরা কি বোঝে না!


শবযাত্রা

কাঁধবদল করছে শববাহকেরা-
              পা ফেল সাবধানে
বাঁ-দিকে পড়ছিল একটূ বেশি ঝোঁক,
              ডানদিক সামলাও
এবার ডানদিকে চাপ রাখতে হবে,
              ভারসাম্য বজায়
রাখতে হবে, ডাইনে-বাঁয়ে, পদক্ষেপে,
              শবযাত্রী সাবধান
শক্ত হাতে ধরা থাক শবাধার
                ছুঁয়ে থাক শব
মিলিত গতির ছন্দ- শ্বাসাঘাতে-
                মৃদুমন্দ আন্দোলিত মাথা
হাত মুষ্টিবদ্ধ নয়, উত্তোলিত নয়,
                অধোমুখ-
কণ্ঠের অনুচ্চ ধ্বনি
              বাতাসে ছড়ায় অমঙ্গল
নিজেদেরই ভয় ভাঙাতে
              থেকে থেকে দু একটা হুংকার
চারদিকে ছড়াচ্ছে ত্রস্ত প্রতিধ্বনি
              গা-ছমছম ভয়
এখন ডানদিকে চাপ রাখতে হবে
              বাঁয়ে যারা- নিজেরা সামলাক

পিছনে, অজ্ঞাতবাসে, রাত জাগে
              সশস্ত্র সন্ত্রাস।              ( ৩০ অক্টোবর ২০০৪)


ছিন্নপত্র ১৯৬৭

আমাদের ডাকঘর ছিল না আমাদের চিঠিগুলির চলাচল হতো
হাতে-হাতে
আমাদের হাতে-হাতে বিনিময়ের সেই আদিম দিনগুলি যখন পৃথিবীর
কবিমাত্রই অজ্ঞাতনামা
আজ এতকাল পর আমরা কি তবে আবিস্কার করবো কোনো প্রকাশ্য ডাকঘর
ও সেই লাল ডাকবাক্স
তোমার বুজে যাওয়া চোখের আড়ালে
তোমার নগ্নতার মতো যা লাল

আমাদের বিচ্ছেদ আজ এতদিনে সম্পূর্ন হয়ে এলো মনে হয়।   


আমার নিজস্ব কোনো বাক্স নেই

আমার নিজস্ব কোনো বাক্স নাই, যেখানে তোমার
উপহারগুলি রাখি। আজ তাই বুকের ভিতর
নিজস্ব কক্ষের ভিত খননের কাজ শুরু হল।
পাতা হল চারিদিকে উপদ্রুত টেলিফোন লাইন,
এদিক-ওদিক কিছু বাস-স্টপ,
রেস্তোরাঁ, ময়দান, অন্ধকার,
তীব্র ইলেকট্রিক ট্রেন, বেশিদূর নিশ্চিত যাবে না।
বাকি থেকে গেল আজও এরোড্রোম বসানোর সাধ।           (২ এপ্রিল-১৯৬৭)




গান

তোমাকে গানের দেবী মনে হয়, কিন্তু কই তোমার নগ্নতা!
যা ছাড়া পায়ের কাছে বসা ভার, ঊরুর উপর ন্যস্ত মাথা
রাখা ভার।
                       তুমি তো গানের দেবী
                       কিন্তু এনেছিলে কোন গান
সে কি রেখেছিলে মনে? কিছু তার জানে কি স্তব্ধতা?
তোমার বিস্মৃতি- সে কি তোমার শাস্তির পরিমান?

তুমি কি গানের দেবী?
                     কেন পাশে রয়েছ শয়ান?
তোমার মাথার কাঁটা বুকে রেঁখে, দেখি না যে ডানার যুগ্মতা!

আমাকে শোনাতে হবে বলে তুমি শেখো নাই
                     কোনো প্রিয় গান।
                                                (১৬ এপ্রিল-১৯৬৭)

স্মৃতিচিত্র(৫)

মনে হয়, কে যেন ডাকল বাইরে
দরজা খুলে দিই।
মনে হয়, কে যেন ডাকল বাইরে
দরজা খুলে দিই।
তবু কেন বার বার মনে হয়
কে যেন ডাকল বাইরে, দরজা খুলে দিই

কে তুমি, কে, বার বার ছায়া ফেলে যাও
আমি তোমার মুখ দেখি না, শুধু ভেজানো দরজার বাইরে স্তব্ধতায়
                       তোমার অবিরাম যাওয়া-আসা
আমাকে ডাকে। আমি তোমার মুখ দেখি না
শুধু ধুলোজমা পাতার আড়ালে, কাঁপা-কাঁপা জোনাকির আলোয়
তোমার দূরাগত স্মৃতির স্পন্দন আমাকে হানে।

কারা কথা বলে দূরে,কারা আসে যায় জানি না,
জানি না আমার দৃষ্টিহীন চোখের আড়াল কারা জেগে উঠল অপলক,
শুধু বিলুপ্তির ঘোরলাগা আলোয় তোমার ঝুঁকে পড়া সীমায়
আমি অনেক দূরের শব্দ শুনি, অনেক দূরের শব্দ
অনেক দূরের শব্দে আমার মন মৌনতার সরোবর
          - জোরে আছাড়ে পড়ে না কখনো-
শুধু দিন আর রাত্রির তরঙ্গিত আয়নায়
আমার আন্দোলিত আকাশ ছোট ছোট ঢেউ হয়ে ভাঙে।
কারা আসে যায় দূরে, কারা কথা বলে

কারা ছায়া ফেলে বার বার, কারা আসে যায় জানি না।
                                        
                                               (১৯৫৬)

বিরোধ

তুমি কবররেখা ঢেকে দিয়েছিলে, সে কি শুধু অকুতোভয়তা?
বলেছিলে, করতলে কিছু স্পর্শসহ থাকা চাই।
শুধু রেখা, শুধু রেখা- এই রেখামাত্র সর্বস্বতা
তোমার সহে না, তুমি বলেছিলে, তবে কি বৃথাই
মুঠি ধরিবার খেলা শেখা হল, বৃথা যাবে খেলা?

জনহীনতায় পথে চৌমাথায় চুম্বনের খরমধ্যবেলা
দ্রুত এসে যায়, তুমি বারন করোনি, স্বভাবত।
স্পষ্টত অর্জন আজও ঢের বাকি, যতটা স্পষ্টতা
তোমার সহে না, তুমি রেখাগুলি ঢেকেছ সতত।
তোমার হাতের নিচে মৃত্যুরেখা-
জেগে ওঠে পরাবাস্তবতা!     

                                             (১৫ এপ্রিল-১৯৬৭)



পূর্ণিমা ১৯৬৭

পূর্ণিমা, তোমার গায়ে গতবছরের গঙ্গাজল
লেগে আছে। তুমি সমসাময়িক হতে শেখ নাই।
তোমাকে যেতেছে আজও স্পষ্ট দেখা,
               তুমি আজও গত বছরের
ফেরিঘাট ব্রিজ স্ট্যান্ড ট্রামলাইন ট্র্যাফিক সংকেত
পার হয়ে দেখা করো, কাছে আসো, বসে থাকো পাশাপাশি,
গত বছরের কাছাকাছি।

তুমি স্মৃতিবিস্মৃতির চেয়ে কিছু বেশি
তুমি নগ্ন করো নীল পান্থশালা।
তুমি পরিপ্রেক্ষিতের অর্থ চাও,-তোমার বিছানা
এইখানে পাতা হবে, তুমি বলো।

পূর্ণিমা, তোমার বুকে গতবছরের প্রাচীনতা।
তুমি রেখেছিলে হাতে, মনে হয়,
চিরজীবনের মুখভার।                         ( ১১ জুন ১৯৬৭। রাত্রি। )


বৃষ্টিপাত হয়ে গেলে

বৃষ্টিপাত হয়ে গেলে রাত্রি এক মাঠের কাহিনি।
শিকড়ে আসক্ত জ্যোস্না, সিক্ত চাঁদ নক্ষত্রনিকরে।
আচম্বিতে দুঃখ জাগে, দুঃখ ঘোর পায়ে পায়ে ঘোরে।
জলের শিয়রে মৌন বৃক্ষ, তুমি কার কাছে ঋনী।

জলের শরীর বৃক্ষ, ছায়া ধরো জলের শিয়রে।
তোমার শরীর বৃক্ষ, স্রোতায়িত নীরব প্রস্তুর।
কেউ অস্ত্র গড়েছিল, কেউ তুলেছিল শান্ত ঘর।
প্রবাহ ফেরাতে থাকো উভয়ে জলের বক্ষোপরে।

প্রবাহ ফেরাতে থাকে বক্ষোমাঝে নিদ্রিতাসুন্দরী।
থাকে অন্তঃপুরে নগ্নঅস্ত্ররেখা সুন্দরী আমার।
কিছুবা প্রস্তর বুঝি, কিছুবা সচ্ছল স্রোতোধার।
শিকড়ে আসক্ত জ্যোস্না , সিক্ত চাঁদ কাঁপে বক্ষোপরি।

বৃষ্টিপাত হয়ে গেলে রাত্রি এক মাঠের কাহিনি।
আচম্বিতে দুঃখ জাগে, দুঃখ , তুমি কার কাছে ঋনী।        ( ৫ জুন ৯৫৯। রাত্রি। )




স্মৃতিচিত্র(১)

আমি ছিলাম, আমি ছিলাম একদিন
যখন সূর্য উঠত নদীর জলে মুখ ধুয়ে
যখন একমাথা এলোচুলে হাওয়ায় হেলে-পড়া গাছ আমার শৈশব
জলে-কাদায় পা ডুবিয়ে অবিরাম কাঁপত,
আর , ঘর থেকে বাইরে আর ঘর থেকে বাইরে আমার দিনগুলি
মনে হত ছেলেবেলার ছড়া।
- তুমি কেন আমাকে ডাকলে, কেন।

আমি ছিলাম একদিন, আমি ছিলাম
যখন মুখে আমার তেঁতুলতলার গন্ধ,
কথায় আম আঁটির ভেঁপু,
আর, চোখের ভিতর চড়ুইভাতির বন পেরিয়ে
ঝাঁপিয়ে পড়া নদী দেখার বিস্ময়।
- তুমি কেন আমাকে ডাকলে, কেন আমাকে ডাকলে, কেন।

আমি তো ছিলাম একদিন, যখন
দিনগুলি আমার, আমার দিনগুলি
মনে হত ঘুমের আগে গল্প আর ঘুমের পর স্বপ্ন,
যখন ভেজানো দরজার বাইরে, স্তব্ধতায়
দিনগুলি আমার, আমার দিনগুলি
মনে হত পাখি সব করে রব সকাল,
আর, নামতার মতো তোমার নামের সুরে সুরে
আমার ধারাপাতের ময়লা আকাশ বেয়ে
জল পড়ত, পাতা নড়ত
ভাঙাচোরা জিনিস বোঝাই চিলেকোঠার আনাচে-কানাচে
পুতুলের সংসারে ধুলো তো জমত না,
কথামালায় বন্দী আমার ছুটির আকাশের নিচে
পাড়া জুড়োত না, কথা ফুরোত না,
শুধু মনে হত
দিনগুলি আমার, আমার দিনগুলি
সহজ কোনো ঘুমের শেষে সহজ জেগে-ওঠা।





হত্যাকারী কে

গ্রেপ্তার,গ্রেপ্তার করো, অসংখ্য চিঠির পরোয়ানা
ছুটে এল অকস্মাত মধ্যরাত্রের চতুর্দিক থেকে,
শব্দের কুকুরগুলি হন্যে হয়,-ঠিকানা না-রেখে
হত্যাকারী পলাতক,-দাঁতে নখে বালিশ বিছানা

বুকের আঁচল, কারুকার্যকরা শায়া, ব্রেসিয়ার
ছিঁড়ে ছিন্নভিন্ন করে শুঁকে দেখে শব্দের কুকুর
চুম্বনবিহীন ওষ্ঠ, সংগমবিহীন যোনি, ক্রুর
রক্তপাতহীন ঠান্ডা জঙ্ঘা জানু,- অযৌন প্রহার

ছত্রখান চতুর্দিকে। শুধু হাত, শীর্ণ দুটি হাত
বড় বেশি অসম্ভব স্পর্শে একা অলীকঅসতী
হয়ে আছে, যেন এই বিপন্নতা ছাড়া অন্যগতি
ছিল না কোথাও, এই অপরাধে আজ ধ্বস্ত রাত

ঘেরাও চিঠিতে, শব্দে- এবং হত্যার রক্তে লাল
নিশ্চিত প্রমান আজও দিতে পারে অমর রুমাল।          (৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬।দুপুর।)


একটি সূর্যাস্ত

পাশাপাশি হেঁটে গেলে ছায়া থাকে এক

আকাশ হোক না দূর  যমুনার
কিংবা কাছে আউটরামের গঙ্গার আকাশ
পাশাপাশি হেঁটে গেলে ছায়া থাকে এক

অথচ মেয়েটি বললো, জানো-

ছেলেটি ভাবলো মনে মনে
এই তো সময়
হোক না শ্রীমতী সন্ধ্যা নাগরিয়া কিংবা শ্রীরাধার
স্খলিত আঁচল
তবু তো ঘুরিয়ে শাড়ি পরবে বিরহনী
দর্পনে সুন্দরী আঁকবে   আত্মপ্রতিকৃতি
পূর্বানুবৃত্তির পর প্রত্যহের রোমাঞ্চ সিরিজ
শেষ করবে একটি পরিচ্ছেদ

তবে কি যৌবন হবে
কাঠের টেবিল ছেড়ে
দীর্ঘ গাছ

অথচ মেয়েটি বললো, জানো
কাল রাত্রে নেভানো উনুনে
মনে হল নিজেকে দেখলাম

ছেলেটি বললো না কিছু
শুধু হাতে হাত রাখলো
যেন হাতের আড়ালে ঢাকলো
কান্না

পাশাপাশি হেঁটে গেলে যন্ত্রনাও এক
                                                   (১৯৫৫)

ইতিকথা

এভাবে দূরত্ব শুরু হয়
এভাবে দূরত্ব বাড়ে দ্রুত
জানি এ-তো কাঞ্চন প্রসুত
তিনি শুধু একাই অক্ষয়  

এরই মধ্যে গুপ্ত সরীসৃপ
অমঙ্গল ডেকেছে টিকটিকি
এরই মধ্যে তবু ময়নাদ্বীপ
হোসেনের গান আছে ঠিকই

কাজ আর দায়িত্বে ভরপুর
আজও চলে শশীর সংগ্রাম
এসব কি কিছু ছাপা নাম?
জেগে ওঠে ছোট বকুলপুর

যাত্রী শুধু নেই একজন
নেই? আছে ক্ষমাহীন নাম
স্বত্বাধিকারীরা পায় দাম
যা হারায়- মাণিক্য-রতন

মূল্য পায় পাঠক খানিক
আর পায় গুপ্ত আন্দোলন
অন্তঃস্রোত-বাহিত জীবন
বিদ্যুত চমকায় দিকবিদিক

তিনি ছাড়া আজও বৃথা জয়
একা তিনি এখনও অক্ষয়!

                                 (২০০৪- অ্যাপেক্স নার্সিংহোম থেকে লেখা)
     

আঘাটার গান

      এই না ঘাটেতে আছে পাতার বিছানা
      সুখেতে রজনী দোঁহে করেছি বঞ্চনা
      মনে না রাইখরে বন্ধু সেই দিনের কথা
      আর না রাখিও মনে সেই মালা গাঁথা।।
                              ....প্রাচীন বাংলা লোকগীতিকা....

কে যেন কেঁদে বলেছে- যাই, যাই
এ ঘাট যদি ভাটার টানে শপথ রাখে নাকো
এ ঘাটে যদি কলসভরা ছল
মনের ভরা ঢলের টান অঝোরে ঝরে নাকো
কে যেন কেঁদে বলেছে- যাই, যাই

ঝরাপাতায় হুতাশ-হাওয়া কেঁপেছে ঝিরিঝিরি
সজনে গাছে বাজনা বাজে না
সজনী, বলো ঘরের পথ কি করে চিনে ফিরি
সাঁঝের দীপে আকাশ সাজে না

আমার সেই ফিরে আসার আশাপথের কাছে
সারাদিনের কাজের শেষে কেউ কি বসে আছে?

কে যেন কেঁদে বলেছে- যাই, যাই


কি করে তবু ভুলি
আমার সেই ভালোবাসার হারানো দিনগুলি?
সেই যে কবে নদীর কূলে-কূলে
কণ্ঠে নিয়ে আকাশমুখী তৃষা
সারা হৃদয় উজাড করে পেতেছি অঞ্জলি
কি করে বলো ভুলি?

নদী, ওগো নদী
তুমি আমার ছেলেবেলার স্বপ্ন নিরবধি
তুমি আমার ছড়ার মতো সহজ কোনও ভাষা
তুমি আমার নিথর স্রোতে বাহিরে আর ঘরে
অবাধ যাওয়া-আসা

নদী, ওগো নদী
তুমি আমার পারাপারের স্বপ্ন নিরবধি

এই যে আমি নদীর ঢেউয়ে সহজ করে মন মেলেছি
এই যে আমি মায়ের মুখে ছেলেবেলার গান শুনেছি
এই যে সারাদিনের কাজে একটি মুখ মনে পড়ায়
একটি গান কেবলই যেন ভুল করায়, ভুল করায়
ছড়ানো ছড়াছবির মতো হারানো এই হাজারো দিনগুলি
কি করে বলো ভুলি?

ঝাউ চেয়েছে আকাশ হতে, আকাশ
মন বলেছে যাস নে দূরে, যাস নে
ঝাউয়ের চোখে হাতছানি দেয় বাতাস
ও ঝাউ, তুই মাটির স্বাদ পাস নে?
মন বলেছে- মাটির বুকে শ্বাস নে

মাটি, ওগো মাটি
তুমি আমার ভালোবাসার আশার মতো খাঁটি

ফুলকে আমি শুধাই
ও ফুল, তুই মাটির কালো বুকে
একটি নিবিড় ঘুমের শেষে একটি জেগে ওঠায়
কি করে এত সহজ়ে মুখ তুলিস?

ধানকে আমি শুধাই
ও ধান,তুই মাটির কালো বুকে
কি করে পাস এত যে প্রানসুধা
কি করে তুই নবান্নের পৌষ-পার্বনে
দু হাত ভরে সাজাস বসুধা?

মাটি, ওগো মাটি
তুমি আমার ভালোবাসার আশায় পরিপাটি!
আমি তো রোজ নিঃস্বতার আর্ত হাহাকারে
শূন্য বুকে জেগে কাটাই রাত
আমি তো রোজ রাত পোহালে
চমকে উঠে দু হাতে মুখ ঢাকি।

এ যেন কোনো পুরানো উপকথা
ভয়ের রাতে ছায়ায় কালো-কালো

পথের প্রতি বাঁকেই দেখি কেউ
রক্তমাখা হাত বাড়িয়ে আছে
জীবন তাই মৃত্যু দেখে আসতে পারে না

দিনের প্রতি বাঁকেই দেখি সাধের সব ভোর
চিতাধোঁয়ায় আকাশ ঢেকে অট্টহাসি হাসে
জীবন তাই কান্না ভুলে হাসতে পারে না

প্রতিটি দিবাশেষেই দেখি ভীষন এক রাহু
আকাশভরা আলোক গ্রাস করে
জীবন তাই কাউকে ভালোবাসতে পারে না

জীবন, ওগো জীবন
একি দারুন বিভেদ আজ
স্বপ্নে
জেগে-ওঠায়!

কে যেন কেঁদে বলছে তাই-যাই
এ-ঘাট যদি ভাটার টানে শপথ রাখে নাকো
আমিও ফিরে যাই

ঝরাপাতায় হুতাশ হাওয়া চায় যে হতে ঝড়
বাজের ডাকে বাজনা বাজে রে
শুকানো এই আঙনে দেখি হাঁকে যে প্রান্তর
শাঙন মেঘে গগন সাজে রে
এবার যদি বিরহিনীর দূরের অভিসার
জাগর রাতে সারাদিনের স্বপ্ন করে পার
আমিও তাই যাই-

সূর্যিঠাকুর, সূর্যিঠাকু, তোমার রথ অনেক দূর যাবে
সূর্যিঠাকুর, সাক্ষী থাকো, আমার পথ অনেক আলো পাবে
আমি তো সেই আশায় দিন গুনি

সোনার পাখি, সোনার পাখি, অনেক দূর ছড়াবে তুমি পাখা
সোনার পাখি, সাক্ষী থাকো, আমার পথ ছায়ায় রবে ঢাকা
আমি তো সেই আশায় গান বুনি

নদীর ঢেউ, নদীর ঢেউ, তোমার মুখ সাগর খুঁজে পাবে!

নদী, নদী, কোথায় যাও
সে দেশ কত দূর
নদী, নদী, বার্তা দাও
আমার বন্ধুর
নদী, নদী, কোথায় যাও
কোথায় সমুদ্দুর

বুকের তাপে কান্না যেন
শিশিরে রোদ্দুরে।।
                                              (.....১৯৫৪)