62nD pOsT : শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়


( কাব্যগ্রন্থ- দূর তরঙ্গ, রঙিন মাছের ঘর, মীরনের ছুরি... )

.......সংসার বাসনা সব ক্ষনস্থায়ী
শোকযাত্রা ফিরে চলে যায়
গোধূলি-আঁধার শুধু জেগে থাকে শব্দময়
শকুনের অনিবার্য ডানায়......


হাওড়ার একটা ছোট কারখানায় কাজ দিয়ে কর্মজীবন শুরু। মেদিনীপুরের রেজিস্ট্রি অফিসে দলিললেখক। ট্রেনে হকারি। ফুটপাতে ফেরিওয়ালা। পলতা ওয়াটার ওয়ার্কসে ১০ বছর । ভারত ফটোটাইপ স্টুডিও থেকে প্রকাশিত চিত্রাঙ্গদা পত্রিকার সম্পাদক। এশিয়া হরফ, ভারবী প্রভৃতি প্রকাশনায় প্রুফরিডার আর সর্বশেষে ১০ বছর দৈনিক আজকাল পত্রিকায় প্রুফরিডার.......বাংলা কবিতার কার্যত নির্জন ও পথহারা কবি শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায় সেই সাথীহীন চৈত্রবাতাস, যার রহস্যঘনতা প্রতিষ্ঠাপ্রেমী বাংলা সাহিত্যে বরাবরই নির্বাসিত থেকেছে। অভিমানব্যথিত কবি নিজেকে প্রান্তবর্তী বলে ফিরে গেছেন হর্ষধ্বনির আড়ালে। ১৯৩০ এ হাওড়ার পঞ্চাননতলায় তাঁর জন্ম , দীর্ঘ প্রায় তিন দশকেরও অধিক তাঁর সাহিত্যজীবন, প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকেই একটা মৌন অবয়বের দিকে অনীহার দিকে হিমসিক্তয়ায় দানা বাঁধে তার পংক্তিমালা। দৃশ্যমান  জগতের অতল থেকে তুলে আনেন যাপনের নৈঃশব্দতা। গৎভাঙা কবি শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়। প্রায় তিরিশ বছর ধরে বাংলা কবিতায় বীনাবতীর অঞ্জলি করেও বাংলা কবিতার কোন সংকলনেই তার কবিতা চোখে পড়ে না অথচ মনীন্দ্র গুপ্ত ও রঞ্জিত সিংহের যৌথতায় একসময় যে এক বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতা প্রকাশিত হত তার প্রায় সবকটিতেই শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা লক্ষ্য করা যায়। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নেই, তাই গিমিক সর্বস্ব বাংলা কবি জগতের তাঁর প্রতি অনীহাই  স্বাভাবিক। শ্রেষ্ঠ কবিতার শুরুতে তিনি নিজের সম্পর্কে বলেছেন-স্বভাবে আমি চিরদিন একটু বাইরে-দূরের মানুষ। জীবনকে ভালোবেসেই নির্জনে নীলিমার দিকে প্রসারিত হয়েছে আমার যাত্রাপথ। যত্নশীল প্রতিষ্ঠার দিকে লক্ষ্য রেখে কখনো কবিতা লিখিনি। তাঁর কবিতায় আমরা পাই এক দুষ্প্রাপ্য আড়াল, গভীরপ্রসারি অনুলিপি। তাঁর অন্তর্জীবনের বিশ্বাসই যেন তাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়েছে স্বতন্ত্র্য ছায়াচিত্র। যেন নিরন্তর খোয়াই থেকে তিনি সুতো গোটাচ্ছেন সুস্থির কোনও স্মৃতির , খুঁজছেন নির্মাণের বীজ- তুমি কি সুজাতা, নাকি দেবযানী? আমি তা জানি না/জানি তবু যৌবনের কন্ঠস্বর এমনি বিহ্বল স্বরে ডাকে/ বিনিদ্র রাত্রির টেলিফোন/ যেন নিশিডাক দূরে- অন্ধকার দক্ষিন হাওয়ায় –“ তাঁর কবিতায় একটা সহজ অন্তর্লোক আছে, নুড়ি পাথরের আনাগোনা আছে, সুকৌশলে অন্ধকারের দখল আছে। উপার্জনের ভেতর একটা বিপ্রতীপ নির্গমন আছে। প্রান্তবর্তী কবি তাই দীঘল অভিমান নিয়ে রহস্য দরোজা থেকে চলে যান বহুদূর অন্ধকারে, সুদৃশ্য দ্যোতক নিয়ে বাংলা কবিতার মূল বলয়ে বুজকরি কাটতে থাকেন শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মত সুকবিরা। প্রকৃতির ভেতর থেকেই দূরতরঙ্গের থেকেই যাপনের মানচিত্র এঁকে গেলেন শম্ভুনাথ, রঙিন ঝিনুক খুঁজলেন সমুদ্রের সাথে ঝগড়া না করেই, আর অসাবধানে রুমাল থেকে বালিতে ছড়িয়ে পড়লে কড়ি ঝিনুক, বললেন থাক, যার জিনিস তার থাক...

যখন বৃক্ষেরা কথা বলে

সন্দেহ আমার, খুব নিশিরাতে বৃক্ষের নিশ্চিত কথা বলে!
মৌন কোন ভাষা, তাই আকারে- ইঙ্গিতে-ইশারায়
তাদের নিজস্ব কথা ফোটে ;

পরীক্ষা করেছি আমি অন্ধকারে, অথবা জ্যোৎস্নায়।
সহসা নিকটে গেলে তারা বেশ সহজ়ে সতর্ক হয়ে ওঠে !
যেন বোবা ! অথচ কী যেন ছিল কিছু আগে, স্থির বৃক্ষতলে !

হয়তো অদৃশ্য চোখে লক্ষ্য করে আমার অদ্ভুত গতিবিধি;
তারপর, তাদের সমাজে কোন বৃদ্ধ প্রতিনিধি
হেসে বলে- লোকটা পাগল !
যেহুতু ইঙ্গিতে বলে, আমি তাই বুঝি না বৃক্ষের গূঢভাষা !

রাত্রির বাগানে শুধু জেগে থাকে আমার নিঃশব্দ চলাচল...

গৃধ্রকূট পাহাড়ে পলাশফুল

নির্জনতা যেন ভগবান তথাগত- গৃধ্রকূট পাহাড়ে
         প্রিয় বর্ষাবাসে এখনো আছেন। একা।
দৃশ্যত এখন গভীর চৈত্রদুপুর। উজ্জ্বল বসন্তদিন
        অরন্যপলাশ
        দেখি বিরহিনী গোপার অধরে স্ফুরিত অভিমান
                                        রক্তরাগরেখা...

তাই সজল শ্রাবনের অশ্রু-স্মরন
সহসা জেগে ওঠে বনপথে অলৌকিক বৃষ্টিপতনের শব্দে।
রৌদ্রে কাঁপে অদৃশ্য জলের কুয়াশা...চকিত ছবি...
                                     সূদূর কপিলাবাস্তু নগর...

তবু নির্জনতা ধ্যানী বুদ্ধ-
তাঁর চোখে পড়ে না আহত ভালোবাসার গভীরতা
                              রক্তপলাশের ছায়া।

মধ্যনিশীথে অরন্যজ্যোৎস্না

লতার ঝুলনে
সংজ্ঞাহারা জ্যোৎস্না দোলে... যেন
রূপসী নর্তকী সলাবতী !

রূপমুগ্ধ দুটি চোখ জেগে আছে আবেশে গভীর
এখনো- প্রাচীন রাজগৃহ।

স্টোন কাটারস আইল্যান্ডে একা

হীরা-চুনি পান্না নয়, দুঃখের পাথর কেটে দিন চলে যায়...
জীবনের সুকঠিন ভাস্কর্য এমন অভিনব ;
যদি বেঁচে আছি তবে শব্দের ভিতরে বেঁচে আছি।
পাথরে আঘাত করি...স্ফুলিঙ্গ জোনাকি ঝরে পড়ে,
এই সুখ হাতে নিয়ে ফিরে যাব সুর্যাস্ত হাওয়ায়।

নাখোদা মসজিদের ভোরের আজান

এমন পবিত্র স্বর মানুষের কন্ঠ থেকে আসে কি?মানুষ
যারা নাকি স্বপ্ন সুখ সীমারেখা, মিনা লতাপাতা
                 মার্বেল পাথরে যেন বেড়াজাল নির্দিষ্ট করেছে
                 স্বরচিত সংসারের নামে;
আসলে সংসার সে তো লোভনীয় মিষ্টদানা চিনির বোয়েম;
যেখানে গভীরে হাঁটে ছয় রিপু লুব্ধ পিপীলিকা-
                  ফুঁ দিলে সরে না, আরো হাত উঠে শিহরিত করে
মুয়াজ্জিন ! তুমি একা উঠে যাও কোন সেই আশ্চর্য মিনারে?
ঘুমন্ত শহর থাকে তোমার পায়ের নিচে স্থির।
আমার আচ্ছন্ন ঘুম ভেঙে যায় অচেনা বিষাদে... কিছু ব্যথা
                 চোখের পাতায় বড় নিয়ে আসে কম্পিত শিশির !
মুয়াজ্জিন! সে কেমন অলৌকিক শব্দের ঘোরানো এক সিঁড়ি
                নিয়ে যায় অন্তিম সোপানে-
অনুভবে, যেখানে আকাশ বলে আমি শুরু আমিই বিশেষ
                আর সব ক্ষণ-সূর্যোদয় !


বিশ্ববিষয়ক কবিতা-৩

দ্বীপবিশ্ব জেগে আছে আকাশরহস্যে- ওই অজবীথি, যমের জাঙ্গাল;
তার নীচে পৃথিবীতে কিছু খেলা, আমাদের জীবনযাপন;
চির অজানার দিকে রয়ে গেল নির্সগকুহেলি, ছায়াজাল-
তবু দেখি ছায়াপথ- অনন্তের অন্ধকারে অতিদূর তারার কাঁপন।

রাত্রিশেষে ফিরে আসে পুবের আকাশে এক সূর্যনক্ষত্রের আভা, লাল;
আমরা কোথায় ফিরি? চিতাকাঠে শ্মশানের আনাচে-কানাচে
অন্য কিছু হাওয়া ওঠে, পৃথিবীকে কার যেন বিদায়জ্ঞাপন !
একটি হলুদ পাখি ডেকে যায় বিকেলের কৃষ্ণচূড়া গাছে-

বিশ্ববিষয়ক কবিতা-৪

এসেছি প্রতিচ্ছায়ার দেশে
এখানে শব্দনীরব নদী-
আকাশে উড়ছে সাদাহাঁস
আসলে প্রাচীন নীহারিকা !

পৃথিবী অন্যগ্রহের কথা-
সেখানে জন্মেছিলাম কবে?
মাটিতে শিকড় নেমেছিল
ছিঁড়চছি অর্তকিত ঝড়ে।

স্থিরতা কোথায় পাবো আমি?
খেলা যে দৃশ্যজগত নিয়ে-
সকালে খানিক দেখা দিয়ে
চলেছি নিরাকারের দিকে !

বিশ্ববিষয়ক কবিতা-২

ছিন্ন ছায়াপথের দুটি উপজগৎ-মেগালানিক মেঘ-
যুগল নীহারিকার শোভা মহাকাশের দৃশ্যলোক আছে;
এই পৃথিবীর বৃত্ত থেকে নভোযানের পূর্নগতিবেগ
লক্ষ আলোকবর্ষ পথেও পৌঁছাবে না জ্যোতির্মেঘের কাছে।
সেই সূদূরে এই গ্রহ আর গ্রহমানব-তুচ্ছকনা-বালি;
ওখান থেকে যায় না দেখা চীনের প্রাচীর, ভূখণ্ড এক ফালি।

বিশ্ববিষয়ক কবিতা-১

মহাবিশ্বের সীমানা বাড়ছে প্রাচীন আকাশে- চিরমহাকাশে;
সেই প্রসারন দশদিকে আরও ছায়ারহস্যে কতদূর যাবে?
কত দুধপথ জ্যোতিরেখাজাল চন্দ্রধারার হীরক কুহেলি
অজ্ঞাত সেই মহা  পরিধির ভিতরে ভাসবে?

সরে যাবে সব মর্ত্যভুবন- সপ্তস্বর্গ-সপ্তপাতাল-
থাকবে না কোনও পূরানবৃক্ষ কল্পনাকথা নন্দনবনে
পারিজাত আর অপ্সরাসখী ইন্দ্রসভার শোভাবর্ণন।
গ্রহমালা ছিঁড়ে শূন্যে হারাবে প্রলয়দিনের অগ্নিবাতাসে-
কালের গ্রন্থি খুলে যাবে, আর নূতন কালের রেশম ছড়াবে।

মহাবিশ্বের সীমারেখা তবে দাঁড়াবে কোথায়- ঘনবীথিকায়
চলনগতির ছায়ামসৃন পথজাল শুধু বিস্মৃতি পাবে?
কী করে তা হবে? প্রকৃতির হাতে রয়ে গেছে কিছু ছন্দের চাল-
বিশ্বনিখিল বিপরীত টানে গুটিয়ে আসবে !
সুখ

সুখ যেন রূপালি তবক মোড়া মিঠেখিলি পান
ইদানীং তোমার অধরে
রঙিন সুগন্ধ এঁকে দিয়েছে- তুমি কি
গ্রীষ্মের দুপুরে কোন শীতলপাটিতে শুয়ে ঘুমিয়ে উঠেছো,
কোন গোপন দরোজা খুলে চলে গেছো আশ্চর্য মাঠের দিকে
বেড়াতে বিকালে-

গভীর সূর্যাস্ত দেখে দেবদারু ছায়ায় বসেছো;
বুক থেকে শাড়ীর আঁচল কিছু খসে গেছে অথচ তোমার
কিছুতে খেয়াল নেই, অধরে রক্তিম এত সুখ
যেন কেউ দংশন করেছে, তুমি তার
শিহরনে নতুন রোমাঞ্চ সুখে অচেতন হয়েছো এখন।

তবে কি সকলে খুব সুখী হয় ভালবাসা থেকে
স্মৃতি থেকে দূরে চলে গেলে ?

টেলিফোনে এক রং-নাম্বার

আমাকে তোমার কোন প্রয়োজন ছিল না কখনো,
আমিও নির্দিষ্ট কারো ঠিকানায় ডায়াল করিনি;
টেলিফোনে শব্দ শুনে রিসিভার যখন তুলেছি-
ভুল করে, হৃদয়জ কিছু কথা প্রথমেই বলেছিলে তুমি।

আমি কি প্রবীর , নাকি সমীরণ? অথবা দীপক?
তুমি অত উদ্দীপক গাঢ় স্বরে কাকে ডেকেছিলে?
পাতার আড়ালে ডাকে যেমন অদৃশ্য পাখি
বসন্ত-কোকিল-
তেমনি তোমার সুরে কিছুক্ষন রাত্রির বাগান ভেসেছিল !

তুমি কি সুজাতা, নাকি দেবযানী? আমি তা জানি না।
জানি তবু, যৌবনের কন্ঠস্বর এমনি বিহ্বল স্বরে ডাকে
বিনিদ্র রাত্রির টেলিফোনে,
যেন নিশিডাক দূরে- অন্ধকার দক্ষিন হাওয়ায়।

যে আসে না, তার স্মৃতি, শুধু তার স্মৃতি কাছে আসে।