“একজন কবির গোটা জীবনটাই একটা দীর্ঘকবিতা-ফল্গু বসু”
........ ফল্গু বসু.....
(কাব্যগ্রন্থ- ‘ভূভারত সুধাময়’, ‘মৃদুচিহ্ন’ ,
‘স্বভাববর্ণ’ ,’অবাধ্যের পুঁথি’,
অক্ষরবল্কল’, ‘ করতলে ভাগ্যরেখা
নেই’, ‘হাঁটছে হাতের লেখা’)
না,আজ কবির মুখপাতটুকু তাঁর
জীবনী দিয়ে নয় বরং জীবনের মধ্যভাগ থেকে যেটুকু কবিতার অন্তরীক্ষ দেখা যাচ্ছে তাই
নিয়েই হোক।কোনো ভীষন আয়োজন নয় বরং জেগে থাকার মাঝেই দেখা যাক আদতে
কোনো জেগে থাকা নেই। যাপনের মাঝেই শব্দের ঘুম নিয়ে কবিতার অন্তবর্তী পংক্তি
নিয়ে খোঁজা যাক এক মদির অপেক্ষমান কবির কন্ঠস্বর । এমন একজন কবি
যিনি কবিতার জন্য কোনো সংগ্রামে লিপ্ত থাকেননি,কোনো নির্বিশেষ সুন্দর আর নির্বিশেষ
পূর্ণের জন্য শব্দের মার্জনা ভিক্ষা করেননি বরং চুঁইয়ে চুঁইয়ে অক্ষরের ফাঁক দিয়ে
অনিমিখ নিখিল মেতে উঠেছে অনুশীলিত বন্দিশে।
|
হ্যাঁ
বিজ্ঞাপিত ভীড় থেকে বেরিয়ে ,গ্রহতারার লীলাখেলা থেকে বেরিয়ে ,চড়া দাগের থেকে বেরিয়ে
মেঠো স্বপ্নকুঞ্জে টিকে আছে সত্তরের কবির অসমতল জীবনযাপন।কাচ্চাবাচ্চা বুড়োবুড়ি
সবাই যখন ব্যস্ত হয়ে খুঁজছে একটি কবিতা ,তখন
ফল্গু ব্সু বিশ্বরূপের সারাংশটা ডুবিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন সদাহাস্যময় জলে,চড়কের ধূলোয়
ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছেন শূণ্যতার তাৎপর্য।কাব্যিক নিরীক্ষণ প্রসঙ্গে মেঘমাটিপ্রথারিক্ত কোনো কিছুর থেকেই কিন্তু বেরিয়ে
আসেননি ফল্গু ,কেবল পরিচর্যা করেছেন ভ্রমণ মধ্যবর্তী অনিকেত ভাষাটিকে।স্রোতপ্রবাহ
থেকে কেবল তুলে নিয়েছেন কবিতার দেহাতী গয়নাটুকুকে। তাঁর নিজের মতে-“ আমি নিজেকে
বাদ দিয়ে চারপাশের যা কিছু আছে-প্রাণ,নিষ্প্রাণ যেকোনো বস্তুর মধ্যে প্রবেশ
করার চেষ্টা করি। তাদের নাড়িটাকে ধরবার
কাজে লেগে পড়ি। যেকোনো বস্তু বা প্রাণীর মধ্যে ঢুকে পড়তে পারলে,নিজেকে ওই বস্তু বা
প্রানী ভাবতে পারলে নিজের ভেতরে অন্যরকম অনুভব হয়। একটি ঘোরের মধ্যে থাকি। যে
চিন্তা করতে পারে তার থেকে চিন্তাকে বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব। কবি এমন একজন মানুষ
যিনি নিজের দেশ কাল সমাজের মধ্যেই দাঁড়িয়ে থাকেন সবসময়। ফলে অনুভব-নিরপেক্ষ সৃজন
অসম্ভবপ্রায় ।“ ফল্গু বসুর কবিতাও তাই সংঘের মধ্যে থেকেও মৃদু অতিমৃদু সন্ধিপত্র
লেখার কবিতা।যেখানে পাহাড় বোঝাতে গিয়ে আশ্রয় বুঝিয়ে বসে থাকেন কবি ,যেখানে উঁচু
করে ছুঁড়ে দেন তাঁর শব্দকে আর পিছনে পিছনে দৌড়ে যায় তাঁর
স্বরলিপি। নাকি আসলে কোনো প্রথাগত স্বরলিপির ধারই ধারেননি ফল্গু! শিল্প ও সাহিত্যের
সাতপাঁচের বাইরের এক অতি সহজ তামসিক আনন্দই তাঁর মৌলিক প্রতিভা।১৯৭৭ অবধিও অসীম
বসু নামে লিখতেন,তারপর একদিন কবি সম্পাদক শম্ভু রক্ষিতের পরামর্শে ডাকনাম ফল্গু
বসু নামে লিখতেই লিখতেই প্রকাশ হতে থাকল ‘মৃদুচিহ্ন’ , ‘করতলে ভাগ্যরেখা নেই’ বা ‘ভূভারত সুধাময়’ এর
মত স্বপ্রতিভ পংক্তিভরা ফল্গুজগত।ফল্গু বসুর কবিতায় ‘কিছুই আর চেনা মনে হচ্ছেনা’ বলে কিছু নেই বরং প্রাত্যহিক দৃশ্যজগত আর
অস্তি জগতের সাথে ক্রমশ ব্যবধানটা কমে আসছে সেখানে অথচ অনুসরন থেকে অস্থিরতার
আঙুলে গড়ে উঠছে এক অভিযানের আয়োজন।আর এই অভিযানেই কবিতার অতিপ্রবেশ্যতা ; এক বৈচিত্র্যপূর্ণ পরিবেশ এক বিচিত্র
দৃষ্টিকোণ ভেসে উঠেছে তাঁর কবিতায়। বিশেষ করে ‘অবাধ্যের পুঁথি’ ও ‘করতলে ভাগ্যরেখা
নেই’ বইদুটি এক্ষেত্রে বিশেষ স্মরনীয়।‘অবাধ্যের পুঁথি’ তে সুচিন্তিতভাবে মনুষ্যতের
প্রানীদের নিয়ে ২৩ টি গুচ্ছ কবিতা (গিনিপিগ
শুঁয়োপোকা,পিঁপড়ে,প্রজাপতি,গিরগিটি,মথ,আরশোলা ইত্যাদি) অথবা ‘করতলে ভাগ্যরেখা নেই’ এর স্থাননাম
শীর্ষক ২২ টি কবিতা(কানসোনা,নাসেরকুলি,কামারপুকুর, কলমবাগান,ঝামটপুর বা সাব্রাকোণ
ইত্যাদি)ফল্গু বসুর নিজস্ব ঘরানার
নিমগ্নতা দেয়।কোনো শেকড়বিহীন নিষ্ক্রিয়তায় শব্দের স্মৃতিচারনা করতে চাননি
ফল্গু বসু বরং তাঁর কবিতাকে সাজাতে চেয়েছেন চেনা রঙে;তাঁর স্বতন্ত্র কবিতার জগতও তাই সরলীকৃত। সেখানে অস্তিত্বের সত্যটুকু আঁকড়ে ধরেই বেড়ে
ওঠা চেতনার অগোচরতা।সেখানেই এক আচ্ছন্ন শহর সেখানেই এক অসুস্থ মেঘ সেখানেই কবির
নিজস্ব যুবক যে জানেনা ঘুমের ভেতর কখন আঁধার নেমে এসেছে,যোগাযোগে নেমে এসেছে
আরেকটি যোগাযোগ ...
চামচিকে
খুব ক্ষুদ্র মনে হয়,নিজেকেই খুব ক্ষুদ্র মনে হতে থাকে,
পৃথিবীর চেয়ে ক্ষুদ্র, গাছেদের থেকে শামুকের চেয়ে বেশী
ছোট মনে হয়, তাই অস্তিত্ব গোপন করে ঝুলে থাকি শাখা প্রশাখায়
ডালে কত পাখি বসে। পাখিদের ব্যঙ্গ শুনে ভাবি,অনায়াস
ব্যঙ্গ করা কি সহজ! যদিও নিজের কাছে শেষ মেশ কারুরই রেহাই থাকে
না ।
আমার পালক নেই,পাখি নই আমি।শুধু আনন্দে উন্মাদ হয়ে
অন্ধকারে ঝুলে থাকি। ইঁদুরেরা খুব বেশী বিরক্ত করে না।
ইঁদুর চঞ্চল জীব, কিন্তু নিন্দাজীবী নয়, তারা
নিজেরাই নিজের কাজে মশগুল হয়ে ঘোরে আনাচে কানাচে
গন্ধে কিছু হেরফের হতে পারে, এই গন্ধ ঘ্রাণ নয়,গন্ধেরেই পুরানো বাংলা
অবিচার ছাড়া যার আর কোনও সাদা অর্থ নেই।
বাইরে জঞ্জাল জমলে ভেতরটা ধোয়ামোছা থাকে
জঞ্জাল বর্মের মত সহজ কৌশল
তাই আমি খুব ক্ষুদ্র, আরো ক্ষুদ্র আরো ক্ষুদ্র হয়ে
অন্ধকারে এক হয়ে যাই ।
কমলাপতি
আমি মোমের সরল বাবা, গ্রহান্তরে
এক ফোট্টা রজনা খুঁজিনা। দেখি, রোজ় সন্ধ্যেবেলা
বসন্ত কেবিনে গনেশ পাইনের কাছে কারা বসে থাকে ।
একটা হলুদ চাবিকে চিৎকারের রং দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে
কেননা এই ভরা চৈত্র মাসে, আমার লক্ষীকে নিয়ে
সাংঘাতিক বিপদে পড়েছি;মরচে পড়ে আছে বলে
কিছুতেই তালা খুলছে না ।
চন্দ্রবিন্দু
চাঁদের মালিক এসে আমাদের পড়শীর উঠোনে
তিনঘন্টা বসে ছিলো, অভিজ্ঞতা
পরীদের চেয়েও বেশী।নাকের দুপাশে
বিন্দু বিন্দু চন্দনের ঘাম, চরিত্রে
কিছুটা আফিম ঘুনের তাপ; আমি
লুঙি পড়া ছিল বলে কাছে গেলুম না
এস্রাজ
বুড়ো আঙুলের সঙ্গে মস্তিষ্কের সম্পর্ক রয়েছে বলে
আবার আদিম উত্তেজনা শুরু হল মাথার ভেতরে
আমার কুড়িটা আঙুলই হস্তান্তরযোগ্য কিনা ভেবে দেখা উচিত
গাছ থেকে পাতা পড়ছে,রহস্যময় পাতা
জন্মের আগে তো আমি সবুজেই মিশেছিলাম অনন্তকাল
এখন কাঁধের ওপরে এই ফাঁকা এস্রাজটা নিয়ে কি করা যায়
কার কাছে যে দরখাস্ত করতে হবে, জেনে নেওয়া দরকার ।
শিখন্ডীবৎ
সব ভন্ডুল হয়ে যাবার পর পোষা বেড়াল ভাবে
কে করেছে? আমি তো নই। কদাচিৎ
তাঁর সঙ্গে দেখা হয় ইঁদুরের,উৎফুল্ল ইঁদুর
সামনে কিছু না বললেও পেছনে হাসবেই
পুলিস উড়ে যাচ্ছে কান্তিমান,দুধসরোবরের দিকে
আমার হয়েছে যত ঝামেলা, নির্বিকার
দেখে যেতে হয়; মন্তব্য করলেই বিপদ ।
স্বপ্নসহচর
সংবেদন
কি লোকালয়ের বাইরে এলেই বিপন্ন হয়?
না
আদতে উল্টোটাই, যেমন তুমি রাস্তা পেলেই
পথ
ভুলে যাও; ঘোরো গোলকধাঁধার মধ্যে
অবিন্যস্ত ।
আবাদি
অনাবাদি জমির পার্থক্যের জরিপ করো
ঘুমের
মৃত্যু স্মরনীয় বলেই তুমি লিখে রাখো
আকাশলিপি।নিজের
আয়না ঢাকা দিয়ে আমি দেখছি
সংসারময়
দুরবস্থা,স্নেহ ভক্তি মাটি হচ্ছে
মুখের
কথায়। এই কি অবক্ষয়ের চিহ্ন? না আপাত
স্বচ্ছলতার
নেপথ্য অতিক্রম দূরূহ অনিবার্য
ম্নান
দারিদ্র্য? লোকালয়ের বিপরীতেই খোলামেলা
স্বরূপ
অনুভবের শান্ত খননকেন্দ্র। তখন তুমি
পাখির
মত। দুঃখ পেলেও আমার কোনও দোষ ধরো না
চিঠি
লিখে ডাকে পাঠাও, অন্ধকারে পালক জ্বলে।
শোনো
বাতাসের কথাও, নির্জনতা খুঁজ়ে আনতে
ঝড়কে
পাঠাও নদীর ধারে, আমিও বেমালুম ভুলে
সঙ্গী
স্বপ্নসহচরকে ক্রমাগতই শান দিয়ে যাই।
শিশুগনেশ
গল্পের গণেশ
রোজ মাছ ধরে হরনদী বিলে
গণেশের বৃদ্ধ
বাপ দিনমানে জাল বোনে, খায়
নিষিদ্ধ আফিম।
জন্মান্তর মানে,ফিস ফিস বলে
‘সমুদ্রে
মাছের আত্মা নবজন্মে ঠিক তিমি হবে।‘
কাহিনী কাঠামো
প্রায় শেষ, প্রলয় অনলে ভূমি
আপেল, দেবতা
মদ না কি নষ্ট গ্রহানু মেশাবো?
বালবাচ্চা নেই
বলে গণেশের বৌটা অসুখী
ভাবে, যদি শিশু
গণেশের জন্ম পুনরায় হয় ...
ইতিবৃত্ত
এখন ঘুমের
চেয়ে অনেক পিছনে পড়ে গেছি
ঘুম যত জোরে
ছোটে অত জোরে পাখীও ছোটেনা ।
বিশের দশকে এক
ছোটখাট পাহাড়ের নিচে
জেগে জেগে
ঘুমোবার কথাবার্তা পাকা হয়ে গেল
পাখীর পোষাক
পরা গুটিকয় সিংহের সভায় ।
সেই থেকে
পাখিদের দুর্দশার শেষ নেই আর
অন্য সব
প্রানীদেরও চোখ থেকে চলে গেল ঘুম
আমরা নেহাৎ
আজও হিসেবের বাইরে রয়েছি
তাই পাতার
তলায় মাঝে মাঝে অগ্নিকনা খাই ।
আসল পাখীকে
দেখি মাঝে মাঝে ঘুমের ভিতরে
মাঝে মাঝে বাজ
পড়ে, পতঙ্গের চেয়ে কিছু বড়
ছুঁচলো তীরের
মত আলো আর দ্বন্ধে মাখামাখি
যত দেখি ততই ঘুমের
চেয়ে অনেক পিছনে পড়ে যাই ।
দয়নিআপাঙ
ফরেস্ট অফিসে
আলো জ্বালে মধ্যরাত
অফিসার দয়নি
আপাঙ জেগে থাকে ।
মৃত প্রেমিকার
চিঠি পড়ে সে জেনেছে
আকাশে
সপ্তর্ষি কিংবা অন্য তারাপুঞ্জ
চিরদিন আকাশে
ছিলনা। প্রশ্নচিহ্ন
ছিল ঠিক
খোনসাঙ চূড়ার নিচেই ।
জোড়া ভুরু
মেয়েটার চোখ দেখে দেখে
নক্ষত্র হবার
জন্য আকাশ ডেকেছে ।
আশ্চর্য আলোর
সঙ্গে তার রূপসীর
সম্পর্কের কথা
জেনে দয়নি নিজেও
জেগে থাকে
রাত্রিভোর চাঁদের জঙ্গলে ।
জিরো
গোলাকার জিরো
এক আচ্ছন্ন শহর ।
নীল পাহাড়ের
নিজস্ব মেঘের কথা
প্রথম জানার
পর অসুস্থ যুবক
দৃষ্টি ফিরে
পেল ফের জলজভাষায় ।
ঝুলন কাঠের
গুঁড়ো নতুন পুতুল
কাগজের
আতাগাছ,উৎসুক দর্শন
সবটাই দুদিনের
খেলা। স্বরলিপি ।
চেনা বা অচেনা
স্পর্শ,তবু ভাপ নিতে
ভালো লাগে
সামাজিক কারনবশত ।
ভিখিরি নবাব
সেই অসুস্থ যুবাটি
নদীর স্রোতের
নিচে পাথর সদৃশ
সিপু কলোনিতে
এসে শান্তিতে রয়েছে
তার কাছে
আত্মপক্ষ সমর্থনই প্রথম প্রেরণা ।
দেওয়াল
গোটা পাহাড়টাকে তো আর পূজো করা যায় না, এসো
একটা জায়গা বেছে নিয়ে মন্দির বানাই
গাছের বরাদ্দ আলো বিলি হবে ভোর থেকে
ছায়া দেবার কার্যভার স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছো শ্যামল
আজকাল কেউ আর বোকা নয়, যৎসামান্য খিদে
মেটাতেই এতদূরে ঠেক।ডাঁটের মাথায়
মন্দির পাহাড় সব আলো করে বসে থাকো
কেউ না কেউ আসবেই।
কেঁচো
ভয়ে সর্বদাই খুব কেঁচো হয়ে আছি
মেরুদণ্ডে গন্ডগোল, জ্যোৎস্নারাত হাসে
সাহসের কথা কিছু মনেই পড়ে না
মাছের খাবার নই তবু মৎসকূল
উপাদেয় ভোজ্য ভেবে আটকে যায় ফাঁদে।
কষ্ট করে খুঁড়ে ব্যবহার করে দেখ
উপকার হবে, লোভে ধৈর্য্যই ভরসা ।
নিশ্চিদ্র খননে যদি না বেরোয় সাপ
প্রবচন মিথ্যে হবে,কদাচিৎ হয় ।
এ যাত্রায় রক্ষা পেলে পুলিস পাঠিও
পাঁচটা ফুসফুস নিয়ে আমরা সবাই
ভয়ে কেঁচো হয়ে আছি, প্রকান্ড উদ্ভিদ
জ্যোৎস্নারাত,সকলেই মনে মনে হাসে
আমাদের পক্ষে সব জানা অসম্ভব ।
মাটিকে মেদিনীজ্ঞান করেই মরেছি ।
পুঁথিবেদান্ত
ছয় ভাই বোন মিলে দাগী তপোবনে বসে
পুঁথি লিখি। কর্মচারী নেই
নিজেরাই পালা করে পাহারা চালাই
হৈ হৈ সংস্রব, ফাটাই বোনের মাথা
দাদাকে কলমে বোঝাপড়া।মাত্র এক ভাই, তাঁর
কাটা পেটে সেলাই রয়েছে। সকলেই জপ করি
পিতৃ-উপদেশ-সম্মান ধুয়ে জল খাবে ছেলেমেয়ে ।
ভ্রমর
ছাপোষা ভ্রমর আমি, সেই কালো ভ্রমর নই গো
কিশোরবয়সে শুধু কিছুকাল ইচ্ছে হয়ে ছিল
ঈগলের জাল থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করে যাবো,;
ইচ্ছে, না রোমাঞ্চ,তাও ভালো করে বুঝতে পারিনি ।
ঈগল ক্ষমতাবতী পাখী,ভূগোল ধরেছে ঠোঁটে
তবু আমি অন্ধকারে বহু দেয়াল লিখেছি
কি লিখেছি মনে নেই, তবে জালের বিরুদ্ধে বেশ
সাড়া পড়ে গিয়েছিল সেই বার। তারপর দেশে
অনাবৃষ্টি হল খুব ঈগলের অঙ্গুলিহেলনে
একদিন শালিখেরা বোনটাকে তুলে নিয়ে গেল
ফুলের ভেতর থেকে। ভাইক শাসিয়ে গেল ‘যদি
দাদার রাস্তায় যাও,ভবিষ্যত নষ্ট হয়ে যাবে।‘
সেই থেকে আমি রোজ ফুলে ফুলে শিক্ষা নিতে আসি
যেকোনো বিষয়ে নিস্পৃহ থাকার সব শিক্ষা
ফুলেদের কাছ থেকে শিখি ।
মাছ
মাছের চিকিৎসা হয় জলের ভেতরে
শ্যাওলায়
অস্পষ্ট বুদবুদ তুলে শুয়ে থাকে
অসুস্থ মাছেরা।
জালে সূর্য প্রদীপের কাজ করে
স্বপ্নের উত্তাপ পেলে
স্রোতের বিরুদ্ধে মাছ
সহজেই চিনে নেয় পথ ।
মাছের অসুখে জল
শব্দ করে না বলে মাছেরা নিশ্চিন্তে শোয়
শ্যাওলায়
ওষুধের বিছানায়
অন্ধকার জলে
মাছেরা ঘুমের মধ্যে
আলো দেক্ষতে পায় ।
আরশোলা
ঘন্টা নাড়ো, জোরে জোরে ঘন্টাটি বাজাও
আমি ক্ষুদে পোকা,খেয়েছি ঘুমের বড়ি
পল্লীর প্রবেশ মুখে আন্দাজে এসেই
গ্রামটিকে বন্ধুদের গুহা মনে হয়
অন্বেষণ শব্দটিকে প্রাণপ্রণে খুঁজি
প্রাপ্তিযোগ যুগে যুগে উচ্চাশায় ভোগে
অন্ধকার থেকে আমাকে উদ্ধার করো
উচ্চাশার মায়াজালে আমি চতুর্ভুজ
ধরাধামে এসে ঝামেলায় পড়ে গেছি
মালের গুদামে থাকি গুড়টুর খাই
তেলের পিপের পাশে নিজের চেহারা
অনুমান করি মাত্র আনন্দে পুল কে
নিমেষে ঘণ্টার সঙ্গে বৃথা তক্কে মেতে
কত দ্রুত পালটে যাচ্ছে মনুষ্য সমাজ
হায়রে নদীর গতি অন্যদিকে চোখ
ঘুম ঘোরে হেঁটে যাওয়া মানুষকে আমি
সুরসুরি ছাড়া কিছু দিতেই পারি না ।
নববর্ষের উনুন
যদি না অস্থিরচিত্ত প্রভাতের সঙ্গে দেখা হয় তাহলে বিফল হবে আসসা।
হাঁসের সাঁতারশিল্প,বট প্রজন্মের প্রতিনিধি, আদরের ধূলোরাস্তা
ব্যাকুল
চৈতন্য এই পথে একদিন হয়ত বা
মহানন্দে চলেছেন নীলাচল
লক্ষ্য করে; ভক্ত
সঙ্গীসাথী সহ।নববর্ষে অতি
প্রয়োজন ভাত
উনুনের আঁচ আর প্রভাতের
স্থান আলোচনা ।
ইতিবৃত্ত অনুধাবনেও কত
সুশোভন ছিলো
জলডাঙা, গরদ পরেছে এই গ্রহ ।
জগদ্ধাত্রী
একা সিংহে বসে আছে,মুখে হাসি
নেই। অবশিষ্ট প্রদীপের তেল
যত্নে সলতে পাকিয়ে রেখে যেও
সন্তানের জিজ্ঞাসার কাছে।
আপাতনী বস্তি
আপাতনী শিরস্ত্রাণ সম্পূর্ণ বেতের
একবার হারিয়ে যাবার পর আর
নিজের ইচ্ছায় ফেরার তাগিদ নেই
সন্ধিগ্ধরা ভাবো, কেন সুযোগ দিয়েছ
হারিয়ে যাবার; নইলে তো পুনরায়
সেই ঘন মফঃস্বলে মানব হৃদয়।
হিমালয় নামে কোনও স্টেশন আছে কি?
ফেংলং কিংবা নিশাং দেখে মনে হয়
থাকতেও পারে। বাসারে দর্জির ঘর
উপলক্ষ সহায় বলেই আশ্রয় পেলাম;
আপাতনি বস্তিতেই বেশ দিন কাটছে
নীড় ছোট, সাক্ষী আমি নিজ়ে উপস্থিত ।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান
আমার মুরগীরা ছোটবেলায় ভীষন হাসতো
বড় হবার পর, অসুখের ভয়ে
সবাই গম্ভীড় হয়ে গেছে। ব্যালট পেপারের বদলে
রেস্টুরেন্টের দেওয়ালে ছাপ মারছেন যে ইতিহাসের অধ্যাপক
শুনেছি তিনিও ঘুমের মধ্যে হাসেন
অনেকের মাথাতেই হঠাৎ হঠাৎ ফুল ফোটার শব্দ শুনে ভাবছি
আমার পোলট্রির অভিজ্ঞতা এইবার
রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে কাজে লাগাবো
ভাসান
কেবল নাতাশার মা জানতো
আমি জলের ওপর বসেছিলাম, আঙুলে
চরকের ধূলো, শূণ্যের তাৎপর্য কেউ নষ্ট করেনি
আলোই বাতাস, আর ছায়া
তবু সদাহাস্যময় জলে
কারা যেন রাইরাজ্য ডুবিয়ে দিয়ে গেল ।
ওতপ্রোত
আমাদের সহায়তা লুঠ হবার সময়
আমরা দৃশ্যের ভেতরে ছিলাম। আহত মেঘ, বিধ্বস্ত বালিকাগণ
ইচ্ছে থাকলেও রুখে দাঁড়াবার জো ছিল না, ত্রাস
পাঠাচ্ছিল হাওয়া; উপদ্রব বুঝবার আগেই
আমি আমাদের থেকে আলাদা হলাম
পুনরায় আমাদের দিবস রজনী চলছে, নিরাসক্ত
কেউ কারো মুখের দিকে তাকাতে অপারগ আমরা।
সুতো
অভিনব ভাত, সাদা নয় , সম্পূর্ণ নীলাভ
চেখে দেখার আগেই
তরল অরণ্যে ফের হারিয়ে গেলাম ।
দম ছাড়ছে পাতা
আর কিছু বলার নেই, বোধাতীত বৈষম্যের কথাবার্তা
এখন আর না বলাই ভালো ।
শেষদৃশ্য
মেঘ ছিঁড়ে গেলে চলচ্চিত্রে আশা পারেখ গান গায়
মেঘের ভেতরে সে গান সত্যিই দেখার মত
বাটিক প্রিন্টের শাড়ীরা ভাসে
মিনিবাসের জানালায়; শুকনো ঘাসের ওপর
বৃষ্টিই পড়লে ঘাম ঝরাতে ঝরাতে
শেষ দৃশ্যেও ঝড়ের সাথে পাল্লা দিয়ে উড়ে যায়
পাখি সিং ড্রাইভার
।
*************