........তারাপদ রায়.......
(কাব্যগ্রন্থ- ‘তোমার প্রতিমা’, ‘ছিলাম ভালোবাসার নীল পতাকাতলে স্বাধীন’,কোথায়
যাচ্ছেন তারাপদবাবু’, ‘দারিদ্র্যরেখা’ , ‘ পাতা
ও পাখিদের আলোচনা’ , ‘ নীল দিগন্তে এখন ম্যাজিক’ ,
‘ ভালোবাসার কবিতা’ , ‘দুর্ভিক্ষের কবিতা’ ,
‘জলের মত কবিতা’,
‘দিন আনি দিন খাই’ ‘ টিউবশিশুর বাবা ‘...)
দুটো কবিতা রাখা যাক পাশাপাশি:-
দাঁতাল শুয়োর নিয়ে খেলা করা,
একমাত্র তোমাকেই তোমাকে মানায়;
বদ্ধঘরে মুখোমুখি চকচকে আয়নায়
নিজের ছায়ার সামনে পরিতৃপ্ত
তারাপদ রায় ।
(একমাত্র তোমাকেই)
|
চতুর চড়ুই এক ঘুরে ফিরে আমার
ঘরেই
বাসা বাঁধে। অন্ধকার ঠোঁটে নিয়ে
সন্ধ্যা ফেরে যেই
সেও ফেরে; এ বাড়ির খড় কুটো, ও
বাড়ির ধান
ছড়ায় শব্দের টূকরো, ঘর জুড়ে
কিচিমিচি গান ।
কখনো সে কাছাকাছি কৌতুহলী দুই
চোখ মেলে
অবাক দৃষ্টিতে দেখে-হ্য়তো ভাবে
লোকটা চলে গেলে
এই ঘর জানলা দোর, টেবিলে
ফুলদানি, বই-খাতা
এ সব আমার-ই হবে;আমাকেই দেবেন
বিধাতা ।
আবার কার্ণিশে বসে চাহনিতে
তাচ্ছিল্য মজার,
ভাবটা যেন- এই বাজে ঘরে আছি
নিতান্ত মায়ার
শরীর আমার তাই । ইচ্ছে হলে আজই
যেতে পারি
এপাড়ায়-ওপাড়ায় পালেদের বোসেদের
বাড়ি ।
তবুও যায় না চলে এতটুকু দয়া করে
পাখি
রাত্রির নির্জন ঘরে আমি আর চড়ুই
একাকী ।
(একটি চড়ুই পাখি)
|
এবার হয়ত টিউব শিশুর বাবা টিউব
মানুষ চেঁচিয়ে উঠবেন এ তো হিউমার! স্যাটায়ার!আয়রনি! হয়ত পাশ থেকে কেউ বলে উঠবে কই!এতো
ব্রম্ভসত্য। প্রকৃতিসিদ্ধি। আত্মউচ্চারনের এক একটা ধাপ,যে ধাপ তার পরের ধাপকে
ছাড়িয়ে যেতে পারেনি,নাকি চায়নি!প্যাঁচানো,বড্ড প্যাঁচানো তারাপদ রায়ের এই সিঁড়িগুলো;
ব্যক্তিজীবনের ছায়া নয় ,যেন স্বয়ং ব্যক্তিজীবনই এসে বসেছে ইনএক্সিসটেন্স ভিসেরালে।তবে,তারাপদ
রায়ের কবিতা ঠিক কেমন? নন্দনতত্ত্ব,গ্রহনতত্ত্ব ঠিক কোন বোধের সন্ধানী তার ছোটোখাটো
হাওয়া তার নিরালা নির্দেশ? না,কবিতার উর্বরভূমি গড়তে কোনো তত্ত্ব নয় কোনো তাপঝাঁঝ
নয় বরং বলা যেতে পারে তার কবিতা প্রচুর পড়াশোনা করেনা কেবল পাতাদের জড়ো করে আর শীতের
কাছে নিয়ে গেলেই আগুন উঠে বসে, হাত পাতে-জ্বালাতে নয় জীবনানন্দে; আর এই কক্ষের
অভিনবত্ব তার বিশালত্ব শুধুই তারাপদের, উত্তরাধিকারহীন বাউন্ডুলে যেন এক বিন্দুতে
দাঁড়াতে জানে না; কোনো দুঃখই যেন তার মধ্যে বাসা বাঁধে না ,নাকি তারাপদ ছাড়া তার
ভেতর তিলধারনের জায়গা নেই? কি আশ্চর্য অনায়াসে তিনি স্ব কে বর্জন করে অর্জন করছেন
নিঃস্বকে; কি সহজেই প্রদক্ষিণ করছেন নিজেকে- ত্যাজ্য করছেন নিজেকে; হাসতে হাসতে পা
মুছছেন যেখানে ওয়েলকাম লেখা নেই। শব্দের যৌথতায় দাঁড়িয়েও যেন অতিদূর নৈঃশব্দে জমছে
শহর জমছে মানুষ ভাঙছে পুরোনো লেপ আর নতুন লেপ বানাতে সাড়ে সাতশো তুলো কমে যাচ্ছে;তার
কবিতায় তাই অসংখ্য পায়ের ছাপ ছাড়া আর কোনো মাপদন্ড নেই;এই সাড়ে সাতশো তুলোর জন্যই
যেন বারবার ঘেঁটে দিয়েছেন তার শব্দের বিছানা –চাদর আর খুঁজে
দেখেছেন নিজস্ব তাঁতঘর যেখানে হাওয়া এসে ছিঁড়ে দেয় কলাপাতা আর দু একটা সোজা রাস্তা
চাইলেই কাটা পড়ে সাড়ে সাতশো বাবলাঝোপ সাড়ে সাতশো বক্রতা;ব্যজোক্তির গড়নে লেখা
কবিতায় সবসময়ই তিনি এক অন্য পাড়া রেখে এসেছেন –রেখে এসেছেন স্বয়ং তারাপদকে যে কথার হিসেব মেলায়নি বরং
কবিতা ছড়িয়ে দিয়েছে কথার আদলে কৌতুকের আভিজাত্যে; সহজ শব্দের কাছে ফেলে গেছেন সবুজ
পাশপোর্ট আর সীমান্তের ট্রেন থেকে ভিজতে ভিজতে নেমে প্রথম জুতো পালিশওয়ালাকে ঈশ্বর
বলে বুকে টেনে নিয়েছেন; বড় গোলমেলে তাই না? বড় ঘুলিয়ে দেওয়া!আসলে, কথাকে উৎসাহী
করতে কৌতুকের আড়ালে যখন দাঁড় করাতে চান নিজেরই অন্তর্মানচিত্রকে,তখন নিমগ্ন বিস্ময়
ছাড়া আর কিইবা অবশিষ্ট থাকতে পারে? তার কবিতার ভাষা সহজ,শব্দটিকে বসাতে সেখানে
অনুমতি লাগে না, তাই হয়ত তার কবিতার পরিচর্যা নেই, পড়ে থাকে সে ছাইরঙা বেতের
চেয়ারে;গোপন থেকে ডালটি উঁকি দেয়, পাখি সেই ডালে এসে বসে, নাড়ায়, আর পাঠক ডাল ধরে
দোলা খায়। আর একটা খুব জোর ফুঁ এসে অভ্যর্থনার দিকে নিয়ে যায় দৃষ্টির ভেতর লেগে
থাকা দর্শনের নিঃসঙ্গ অংশগ্রহনটুকু।আর তারাপদ? সিরিয়াস কবিতার কোষ্টীচক্রে সহজাত
কবির সাক্ষাৎকার কে নেবে? নিরূপায় যাত্রীর মত কোনো রকমে মাথা গুঁজে পাদানিতে ঝুলে
থাকেন। তিনিও তো চান প্রয়োজনহীন বেঁচে থাকতে কারন আয়না ভাঙতে ভাঙতে কবেই তো তোলা
হয়ে গেছে সেই সহজ বাতাস সেই ঝকঝকে মেঘ। এখন পাপোষে পা মুছে ফিরে যেতে চান গন্তব্যহীন।
লক্ষ্যহারা । পাঠক খুঁজুক, এধার থেকে ওধার-দাঁত নখ হারানো খোলা জানলায় ………
কতদিন
পরে
ফিরে
যাওয়া যায় ।
হঠাৎ
পথে নেমে, জামতলা পার হয়ে
একপাধূলো
আর হাত-ভরা শাঁপলার ফুল
তোমার
দরজায় গিয়ে দাঁড়াতে পারি ।
সন্ধ্যাবেলা
। রান্নাঘরের ফাঁকে কেরোসিনের কুপি জ্বলছে,
হলুদমাখা
হাতে আলগোছে ঘোমটা টেনে
তুমি
বললে
‘কতদিন
পরে এলে’ ।
তখন
সারা উঠোণ ভরে বাতাবির ফুল ছড়িয়ে আছে ।
মাঘের
স্তব্ধ হাওয়া
পুকুরের
জলে জোনাকির ছায়া ।
কত
দিনের কত ছবি ।
তবু
কি ফেরা যায় ।
কমলালেবু
তোমার হাত থেকে এখন আর গড়িয়ে পড়ে না
কমলালেবু ,
তুমি নিজেই আঙুল দিয়ে খোসা ছাড়াতে পারো,
গলায় ব্যাথা হলে তুমি এখন কত সহজ়ে
নুন-জল দিয়ে গার্গল করো ।
তুমি জেনে গেছো একতলার থেকে দোতলায়
অনেক বেশি আলো এবং হাওয়া,
ট্যাক্সি ও ট্রামের দূরত্ব ও
ব্যবধান ।
তুমি সব ব্যবধান বুঝে ফেলেছো ,
তুমি বুঝে ফেলেছো বৃষ্টিতে ভেজার আনন্দ
তুমি বুঝে ফেলেছো জ্বর হলে সবটাই খারাপ লাগে না ।
শিয়ালদহ
স্টেশন যথার্থ বেড়ে যায়,
শিয়ালদহ নর্থ এসে সার্কুলার রোডের উপর
আচমকা হুমড়ি খেয়ে পড়ে ।
দিগন্তে, দিগন্ততরে ছুটে যায় কয়লা বা বিদ্যুৎবাহিনী
দীর্ঘ ট্রেন ,
শহর গ্রামের কাছে গিয়ে হাত পাতে,
বলে,
‘কিছু
চাল , ডাল, কলাপাতা,
পানাপুকুরের জল,মাছ,ঘি-দুধের গন্ধ
দাও
দেখি
তুমি হরতালে,বাংলা বন্ধে কি রকম আছো ?
কাঁঠাল গাছের নিচে ইট রঙা খুচরো স্টেশন,
বৃষ্টি ভেজা ঝাপসা চোখ অশ্রু ছলো ছলো
ম্লান ঠোঁটে হাসি টেনে লেভেল ক্রশিং
বলে, ‘বলো কি রকম দেখতে চাও বলো ।‘
আগের দিন সকালবেলা
আমার বাবার রাঙাপিসেমশায়ের
পাখির পালক জমানোর শখ ছিলো;
নানা জায়গার নানা রঙের পাখির পালক
তিনি কুড়িয়ে এনেছিলেন,
তাঁর ঘর-বারান্দা-সিঁড়ি ভরে গিয়েছিলো
রঙিন পালকের ছড়াছড়িতে ।
পৃথিবীর যে-কোনো গাছের যত পাখি
তার যত পালক,
তার চেয়ে অনেক বেশি সংগ্রহ করেছিলেন
বাবার রাঙাপিসেমশায় ।
মৃত্যুর আগের দিন সকালবেলা
সূর্য ওঠার আগে ছাদে উঠে,
সূর্যের সাতরঙের সঙ্গে মিলিয়ে হাওয়ায়
তিনি উড়িয়ে দিলেন সেইসব পালক
কিছু মাটিতে পড়ে গেলো,
কিন্তু কিছু উড়ে গেলো কোথায় বহুদূরে ।
এই ঘটনা নিয়ে গল্প হয় না, কবিতাও না
কিন্তু কিছু পালক ভেসে বেড়ায় চিরদিনের শূন্যে ।
কথায় কথায়
ছবির মতো আকাশ,
আর আকাশের নিচে সেই বোকা মানুষ
যার কথায় কথায় চোখে জল আসে ।
আর যখন চোখে জল নেই,
তখন চোখের মণিতে এক ছায়াভরা বুড়ো আম গাছের নীচে
বিরাট দুপুর, আটচালা ঘরের বারান্দায়
মানুষজন রং-বেরং বিড়ালের ছানা
উঠোণ থেকে খড়ের টুকরো মুখে করে ছুটে পালাচ্ছে
ছাই ছাই ধানি ইঁদুর ।
এ ছবির কোথাও সে নেই।
তবুও আটচালা ঘর, রঙিন বিড়াল
আর ধানি ইঁদুরের ত্রস্ত চলা ফেরা
সারা দুপুর বারান্দায় কারা সুপুরি কাটছে
ধান থেকে চাল কুটো বাছছে তো বাছছেই ।
কথায় কথায় তার চোখে জল আসে ।
তোমাদের কথা
বৃষ্টি হলে তোমাদের কথা মনে পড়ে,
বৃষ্টি না হলেও তোমাদের কথা মনে পড়ে,
যখন অনেক কাজ,
যখন কোথাও কোনো কাজ হাতে নেই
বৃষ্টি হলে,
বৃষ্টি না হলেও
তোমাদের কথা মনে পড়ে ।
আজ অনেকদিন কারো কোনো চিঠি পাই না, অনেকদিন
কারো কোনো খবর রাখি না,
তোমরা কে কীরকম আছো ?
তোমাদের পাড়ার ডাকঘরে
খাম, পোস্টকার্ড এখন কি খুব অকুলান
?
নাকি তোমরা সকলেই
ডাকঘরের রাস্তা ভুলে গিয়ে
ঠিকানা হারিয়ে,।
এখন যে যার ঘরে বসে-বসে ভাবো,
‘সেই লোকটা এতোদিনে সত্যিই হারালো।‘
নিশ্চয় পৌঁছাবো
নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো ।
তার ঠিক মাঝখানে পুরনো পাগল দাঁড়িয়ে ।
তাকে বারণ করলেও
সে সাঁকো নাড়াবে,
তাকে বারণ না করলেও
সে সাঁকো নাড়াবে ।
কিন্তু যাবো । আপনাদের কাছে যাবো ।
একদিন সব পাগল পাগলাগারদে থাকবে ।
একদিন অনায়াসে ঐ সাঁকো পার হয়ে যাবো,
একদিন পৌঁছাবো ।
একদিন জঙ্গল ভেঙে, কাঁটাবন ডিঙিয়ে,
একদিন বন্যার জল উজিয়ে,
একদিন খরায় ধুঁকতে ধুঁকজতে,
একদিন লঙ্গরখানার ভিড় ঠেলে,
একদিন অবশ্যই আপনাদের কাছে পৌঁছাবো ।
বিশ্বাস করুন, নিশ্চয় পৌঁছাবো ।
আপনাদের কাছে পৌঁছাবো ।
কোথায় যাচ্ছেন তারাপদবাবু
কোনোদিন দেখা হয় না ।
কোনোদিন কারো সঙ্গে দেখা হয় না ।
যেন মধ্য সমুদ্রের নিরবধি জল,
নিঃসঙ্গ জেলে-ডিঙি
কয়েকটা খুচরো মাছ, নিরিবিলি একাধিক পাখি
নোনা, আঁশটে গন্ধ-
জলে তেমন কোনো ঢেউ নেই
গোলমেলে হাঙরের পর্যন্ত দেখা নেই
এ কেমন মাঠের মত শান্ত, অসহায়
যেন নীলঘাসের গালিচায়
নৌকা না আরাম কেদারা?
কোথায় যাচ্ছেন তারাপদবাবু ?
থাকুক
এসব কবিতার কোনো জায়গা ছিল না ভ।
বহুদিন আগে এক ঝড়জলের রাতে
এদের ঘর থেকে বার করে
দেয়া হয়েছিলো ।
তারপর থেকে,
ছন্নছাড়া,ভবঘুরে,ময়লা,ছেঁড়া
কাগজের বিবর্ণ পৃষ্ঠায়
প্রায় অস্পষ্ট হয়ে আসা কবিতাগুলি
শহরের পথে পথে ঘুরে এতদিন পরে
আবার ঘরের সামনে এসে
দাঁড়িয়েছে ।
ওদের আসতে দাও ।
ওদের মাথা আচড়িয়ে দাও ।
ওদের ফর্সা, ধোপদুরস্ত জামাকাপড় দাও ।
ওদের একবাটি গরম দুধ, আর তার মধ্যে
দু আউন্স ব্রান্ডি দাও
।
এতদিন পরে যখন এসেছে
থাকুক ।
ঠাণ্ডা মেসিন
সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছে
আমাদের পুরনো ঠান্ডা মেশিন ।
বারান্দায় গিয়ে তাকিয়ে দেখলাম,
রঙচটা, পায়াভাঙা,নড়বড়ে
পঁচিশ বছরের পুরনো
আমাদের ঠান্ডা মেশিন
ঠেলাগাড়িতে উঠে চলে যাচ্ছে ।
তাতাই বড় হচ্ছে,
আমরা বাসা বদলাচ্ছি ,
সেই সঙ্গে বদলাচ্ছে মিনতি ও বিজন ।
আমি এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে,
এক কলম থেকে অন্য কলমে,
দাদা-বাবা-মা, বড় দিদিমা-রাঙা পিসিমা,
চন্দ্রবিন্দু ।
এক বাটি ঝোলের মধ্যে এক টূকরো মাছ,
এক ফালি তরমুজ, সিকি বোতল দুধ ।
আমরা আর একটা ঠান্ডা মেসিন ।
ঠেলা গাড়ীটা দূরে চলে গেলো
এখন আর বারান্দা থেকে দেখা যাচ্ছে না
অনেকদিন আগের এক জামগাছের নিচে
একটা খড়ে ছাওয়া গোয়ালঘর
আমার ঠাকুমার দেয়া একটা সিঁদুরের ফোঁটা
আমাদের বুড়ি লক্ষী গাইয়ের কপালে
সেদিন কশাইরা তাকে নিয়ে গিয়েছিলো ।
বারান্দা থেকে ঘরে ফিরে মনে হলো
একটা সিঁদুরের ফোঁটা কম পড়ে গেলো ,
আমাদের ঠান্ডা মেশিনের কপালে ।
পাতা ও পাখিদের আলোচনা
দশটি শালিকের সঙ্গে কাঠচাঁপা গাছের পাতাদের
সভা শেষ হয়ে গেলো সকাল পাঁচটা পনেরোয়
কয়েকটি নতুন ফুল ফুটবে
দুই এক দিনের মধ্যে,
তাই নিয়ে এই আলোচনা ।
আরেকটি নতুন ফুল ফুটবে
হালকা সোনার কালিতে ঈষৎ দুঃখের মত
গত জন্মের সৌরভ
শালিকদের যাতায়াতের পথে ট্রাফিক আলোর মত
কয়েকটি নতুন ফুল
ঈষৎ সোনা রঙের দুঃখ,চির হলুদ,
তাই নিয়ে পাতা ও পাখিদের আলোচনা।
লাল ডায়েরি
প্রত্যেকের বাড়ির ঠিকানা আমি লাল ডায়েরীতে
টুকে রাখি, খুব বর্ষাকালে কিংবা কোনো এক শীতে
চলে যাবো । ওভারকোট, গরম দস্তানা-
হয়তো অবাক হবে নাকি
কিছু নয়,
‘কী খবর, এখন কী মনে করে?....এত কুয়াশায়
বাড়ি চিনতে কষ্ট হলো খুব ?’
কোথায় কুয়াশা ,
এ ঠিকানা এপ্রিল মাসের । তখন আকাশ পথঘাট
খুব ঝকঝকে ছিলো, তোমার বাড়ির সামনে
বকুল গাছের ডালে
শালিকের বাসাভরা ফুল ।
কি আশ্চর্য !
তোমার বাড়ির সামনে বকুল ছিলো না ,
আমার ডায়েরিতে দ্যাখো,
এই তো বকুলগাছ, এই কমাটার পাশে শালিকের বাসা ।
সমস্ত ঠিকানা কবে ছবি হয়ে গেছে ,
যে যার বাড়িতে আছো ।
বর্ষাতি জড়িয়ে আমি প্রথম বৃষ্টিতে চলে যাবো ।
তোমার বাড়ির পিছে কদমবাগান,
ফুল ফোটে আমার ডায়েরিতে
।
টিউবশিশুর বাবা
টিউবলাইটের নিচে
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে
একজন টিউব মানুষ ।
একটু আগে,
টিউব থেকে মাজন বের করে
দাঁত মেজেছে ।
টিউব থেকে সাবান বার করে
দাড়ি কামিয়েছে ।
এখন টিউব থেকে ক্রিম বার করে
মুখে মাখছে
একজন টিউব মানুষ ।
একটু পরে তাকে বেরোতে হবে ।
দশটা দশের টিউব রেল ধরার জন্য ছুটবে
টিউব শিশুর বাবা
টিউব মানুষ ।
সবাই ভালো আছে
বহুকাল আমরা কোনো সুসংবাদ পাইনি ।
কেউ একটা ভালো খবর নিয়ে আসেনি ,
সাইকেল পিয়ন এসে বলেনি, ‘বকশিস দাও ।‘
বকশিস দিতে আমাদের আপত্তি নেই ,
কিন্তু দিনের পর দিন আমাদের বন্ধুরা
শুকনো মুখে টেবিল ঘিরে বসে থেকেছে ,
আমাদের আত্মীয়স্বজন বছরের পর বছর
হাঘরের মতো রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে ।
কয়েকটা কনকচাঁপার গাছ ছিলো আমাদের
বহুকাল তার ডালে কোনো রোমাঞ্চ নেই,
একটা লেজফোলা সাদা বেড়াল ছিলো আমাদের
অনেকদিন তাকে দেখিনি, অনেকদিন সে ঘরছাড়া ।
এইভাবে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে রৌদ্রে পুড়তে পুড়তে
আমরা গরমে তেতে উঠি, ঠান্ডায় কুঁকড়ে যাই
আমাদের খাবার ফুরিয়ে যায়, জলের কলসী ভেঙে যায়
আমাদের ছেঁড়া গামছা, জামা বদলানো হয় না ।
এইভাবে দুঃখ করতে করতে আমরা,
আমাদের বন্ধুবান্ধব, আমাদের আত্মীয়স্বজন
একদিন স্পষ্ট টের পাইয়া, একদিন বুঝে ফেলি
সবাই ভালো আছে, আমরাও ভালো আছি ।
********************************