59Th pOst : সুশীল ভৌমিক


........সুশীল ভৌমিক.......
(১৯৩৮-২০০৭)
(কাব্যগ্রন্থ- আমি তবু, নির্বাচিত কবিতা...)

কয়েকটা বাড়ির ওপাশে জন্মালে হয়তো
                  এসব এড়ানো যেত
অথবা দু-একবছর আগে কিংবা পরে
সেদিন যে ঢিলটা কপালে লেগেছিল
দু-এক মিনিট আগে কিংবা পরে এলে
                  তা-ও লাগত না
পুলিশ, বিশ্বাস করো, আমি এর বিন্দুবিসর্গও জানি না
আমার স্বয়ম্ভরে আমি অনুপস্থিত জেনে
                নির্ঝঞ্জাট দুঃখে
                          সিগারেট টানছিলাম
তোমাদের দেখে হঠা ভয়ে দৌড়তে থাকি
আজও আমার বন্ধুরা আমাকে ঘরে না পেয়ে
                    ক্ষুন্ন হয়ে ফিরে যাবে
কিন্তু ঘুমের মধ্যে দেখা পুকুরের ভেতর থেকে
                        আমি কিছুতেই উঠতে পারছি না


ষাটের দশকের কবি সুশীল ভৌমিক। তথাকথিত বাংলা বাজারের আর মসৃন দিনযাপনের থেকে তনিষ্ট দূরত্বে থেকে প্রচারবিমুখ কবির বাক্যনির্মান, শেষ অবধি অস্বীকারের স্পর্ধা। শব্দের উল্টোদিকে হাঁটতে হাঁটতে ভেতরবাড়ীর সংক্ষিপ্ত কুশলেই তাঁর সহজ যাতায়াত। কবি সম্পাদক সঞ্জয় ভট্টাচার্যের অত্যন্ত প্রিয় এই কবির সম্পর্কে যতটা বলা যায় তার চেয়ে অনেক বেশী সম্ভাবনার কথা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাঁর ডিকশনে, তাঁর অবোধ্য শূন্যময় ঘুনে কাটা বই, পোড়া ঘোড়া কিংবা থম্বোফোমের ছবিতে। সুশীল ভৌমিক মানেই চৌকির তলায়, টেবিলের বইয়ের ফাঁকে গুঁজে রাখা বাতিল বাক্যবন্ধের মিতকথন। তাঁর অনেক কবিতাই তিনি লিখে তৃপ্ত না হয়ে ছিঁড়ে ফেলে দিতেন যার ভেতরে লুকিয়ে থাকত বাংলা কবিতার মৃত্যুঞ্জয় মনিরত্ন, অনিয়মের ভেতরই যেন অনির্দেশ সমগ্রতা। তাঁর নিজের কথাতেই-ব্যক্তিগত জীবন ও কবিতায় আমি পুড়েই যেতে চেয়েছি- সঠিকভাবে এই ছিল কবিতায় আমার উদ্দেশ্য। আর্টকে ভীষনভাবে শ্রদ্ধা করেও আমি নিরপেক্ষ, সমৃদ্ধ ও পরিদৃশ্যমান মননবৃত্তিকে অগ্রাধিকার দিতে পরাঙ্মুখ আগাগোডাই।।...... আমি পুনঃমার্জনার পক্ষপাতী ছিলাম না এজন্যে যে প্রত্যেক মূর্হুতের মানুষ আলাদা, অসত্যের সম্ভাবনাও থেকে যেত না হলে। বহরমপুরের পিলখানা রোডের বাড়িতে থাকতেন সুশীল ভৌমিক। সারাগাছি রামকৃষ্ণ আশ্রমের আগেই ৭৭/১ নম্বর একতলা বাড়ি।এই সারাগাছি রামকৃষ্ণ আশ্রমেই শিক্ষকতা করতেন ইংরেজি সাহিত্যের। সম্পাদনা করেছিলেন পোয়েট্রি ইন্টারন্যাশানাল নামে ইংরেজি সাহিত্য পত্রিকা।সুশীল ভৌমিকের মত বড় মাপের কবিকে , তাঁর কবিতার শুদ্ধ চৈতন্যকে পেরোতে গেলে কাব্য ও মননের কিছুটা ইথসেটিক ইনোসেন্সির দিকে আমাদের ফিরে যেতে হয়। দুই চোখ ফুটো করে অনুবীক্ষন বসাই সেখানে/ ভীষন ছোট দেখি রাত, ভীষন ছোট এইসব আঁধার/ ছাদের ওপর থেকে দৃষ্টি আসে, সেও বড় নয়/ গাছ থেকে কুলকুচি পাতা পড়ে আর সাদা ফুল...।ভীড়ভাট্টা ঠেলে ক্রমাগত তাঁর কবিতার বেড়ে ওঠা, যাপনের মহড়া। সন্নিবিষ্ট কোলাহলে কেউ তাকে দেয় একপ্রস্থ দেওয়াল কেউ দেয় শিলীভূত ঘুম আর এই কোলাহলেই তাঁর নিজের হাতে তৈরী সেই বায়বীয় শূন্যতা যা প্রতি মূর্হূতে খুঁজে ফেরে আনন্দের বিরুদ্ধতায় অনায়াস ডিসোলেশন।২২ অক্টোবর ২০০৭ এ প্রয়াত হন সুশীল ভৌমিক। এত অল্প পরিসরে সুশীল ভৌমিকের মত অন্তঃপুরবাসী বিম্বিত কবির নিঁখুত চয়ন সত্যিই দূর বিস্মরন ছাড়া আর কিছুই নয়। মৃত্যু পরবর্তী কালে তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্যে নুরুল আমিন বিশ্বাসের রচনার কিছু অংশ কেবল ভেসে ওঠে সময় রদবদল করে- গভীর অধ্যাবসায় এবং সুক্ষ মনন দিয়ে তিনি যে জ্ঞান ও দর্শন অর্জন করেছেন তা তাঁকে দিয়েছে প্রগাঢ সময়বোধ ও বিশ্ববীক্ষার পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র। যে কারনে নিজস্ব জীবনপ্রনালী থেকে অর্জিত অভিজ্ঞতাকে তিনি কবিতার শরীরে সামাজিক উচ্চারন প্রদান করেন। এই অনুপুঙ্খে তাঁর কবিতা লোরকা, সমর সেন, শামসুর কিংবা বিনয় সকলকেই হয়ত ছুঁয়ে ছুঁয়ে থাকে; কিন্তু তাঁর কবিতার অন্তর্বয়নে গভীর পাঠ নিলে দেখা যাবে তাঁর বাচনিক অভিব্যক্তি নিজস্বতায় ভাস্বর। ক্লান্তিহীনভাবে প্রতিটি চিত্রকল্পে তিনি সত্যের নিয়ন্তা, আবার বিনাশীও; নিজেই তিনি মূর্ত-আবার বিমূর্তও!নিজস্ব উচ্চারনেই তাই তিনি র‌য়ে গেছেন পাঠকের অন্তরেঃ  

O

আমার  ও সব মানুষের মধ্যে ফাঁক কাটাকুটি
কমা, ড্যাশ, চাঙড়, বরফ, চূন, সিমেন্ট
               স্টিল ও সানমাইকা
শরীর জন্মায় না এখানে
নেই বুকের উচ্চতা, উচ্চতা থেকে
পায়ের পাতা পর্যন্ত অথবা নখে অবলম্বনহীন একা
তারাদের উজ্জ্বলতা কাচের মধ্য দিয়ে কাঠের ভেতরে
তারপর স্টোণচিপ ও আলকাতরা
তার মানে রাত মানে খোঁচা, লম্বা কাটা,
মাংসের যন্ত্রনা শুইয়ে রাখি এই কোন রাতের
                  ঘুম নামক ওষুধে প্রতিদিন
স্টিলের বেঞ্চ এসে ঝরে পড়ে-
ঝাপসা নদীর দৃশ্য বেজে ওঠে, ঢেউ এবং পাড়

বেজে ওঠে নৌকোর গলুই-এর অক্ষম জাল,
পাহাড়ের রঙ নেই, শুধুমাত্র আছে আছে জানি
অথবা নেই, মাথার অসুখ থেকে ক্রমশঃ নিউরোস্ট্রাট
                   হয়ে নিজেকে সারাচ্ছি এখন

আমার জন্য রাত দশটায়

আমার জন্য রাত দশটায় কোন ঘর খুলে যেতে পারে
আমি কিন্তু আদৌ জানিনা আমার জন্য কয়েক জোড়া জুতো
                 বাইরে চন্দ্রালোক মেখে আছে কিনা
আমি কি কয়েকটি হৃদপিণ্ড বাইরে আঢাকা রেখে পাপ
                   কোরে যাচ্ছি ক্রমাগত?
আমি কোন বন্ধুর নাম ভুলে গেছি- কোন
               অবশ্য সাক্ষা এড়িয়ে অব্যবহৃত জঙ্গলে আছি
আমার জন্যে কেউ আজ ঘন ঘন মৃত মানুষের মতো
               খারাপ সুইচে হাত রেখে
আমার জন্যে রাত দশটায় কোন ঘর খুলে যেতে পারে

সৌন্দর্যের কাছে

আমি
        সৌন্দর্যের কাছে যাই
আমার বুকের চেয়ে ছোট
        এই সৌন্দর্যের বুক
আমার কথার চেয়ে ছন্দহীন, আন্তরিকতাহীন
    কুঠারের শব্দের মতো
        মাঝরাতে সৌন্দর্য
            ঘুমায় এখানে
বিশাল মেহগনি শয্যার মতো আমি পাই তাকে
তুষারে গাছের মতো সৌন্দর্য বা ক্ষয়
মহত ব্যক্তির নামে যে-পথ ঘুরে ঘুরে যায়
           তাতে পাই ভিখারির ফেরার
                         গোলাপ।

অসুস্থতার গল্প

অসুস্থতা, আমিও প্রেমিক
অসুস্থতার পাশে বসে অসুস্থতা, জানি
তবু-ও পার্কের বেঞ্জে মৃদু হাওয়া-বিনয়ী বাদামওলা
আসে সন্ধ্যা এলে
মামাতো বোন রোজ ফোন তুলে খোঁজ নেয় মামাতো বোনের

এইটুকু জানা হলে
করিডোর ক্রমাগত বাঁকা ও ফাঁকা হতে থাকে
দ্রুত হেঁটে নার্সরা ড্রেস খুলে নেমে যায়
পুরুষ নামক শ্লথ অবকাশে
দূর থেকে দেখা নদী শাদা হয়......

আমার অসুস্থতা স্যুটকেস নিয়ে ছোটে ভিড়ের ভেতর
অসুস্থতা, অসুস্থতা, অসুস্থতা;
এখনও তো ঝুঁকে আছি উত্তর দিকেই
আমিও প্রেমিক জেনে ওষুধ ও পৃথিবী আছে,আর কিছু নেই


বাঘ

একদিন বাঘের গলায় ছিল তুমুল গর্জন-
আসলে, তার গায়ে কি ঠিক কালো ডোরা ছিল, না কলেজ স্কোয়ার
প্রতিবাদ, ভালবাসা, ক্রোধ ছিল
               অদ্ভুত মিশ্রনে একাকার
একমাত্র হরিণ বা প্রেমিক ছাড়া আর কেউ ছিল না সেদিন
               বনে বা শহরে
জীবনের চেয়ে আর অভ্রান্ত সত্য-ও ছিল না
মিথ্যার চেয়েও কোনও দুর্লঙ্ঘ্য মিথ্যা ছিল না
পাণ্ডুর বর্ণের চেয়ে, আর কোনও পাণ্ডুরতা ছিল না
একমাত্র বাঘের পৃথিবী-কাঁপানো আওয়াজ
              নাকি আত্মায় কোনও অদ্ভুত ফুল ফুটেছিল?
 

পরাজিত ঘুড়ির মতো

আমি এখন পরাজিত ঘুড়ির মতো উড়ে যাচ্ছি
আমার ভেতরে টরেটক্কা শব্দে ঘুনেরা আমার টেলিগ্রাফবাহক
তাছাড়া কোনও চিঠির শব্দ বহুকাল নেই, ছিলও না বোধহয়
যেন কোনও নারী সেজে একটি পুরুষ আমাকে ক্রমশ
                   টেনে নিয়ে যাচ্ছে ঘাতকের মতো
আমার পোশাক খুলে যাচ্ছে- আমার সমস্ত শরীর
আমার রক্ত থেকে পরিচিত নকশাগুলি-

স্বপ্ন

কবিতার কথা ভাবলেই পুরনো ঠেকে এসে উঠি
হারমোনিয়ামের রীডে বক্সিং ও কানচাপাটির ধুলো পড়েছে
আরে বাংলা পড়াতে পড়াতে নির্ঘাত মাইকেল হয়েছে
                      বিধান লস্করের ছেলেটা
ড ড বিশ্বাসকে আর চেনাতে হবে না, সেই যে...
বাতি নিভিয়ে ধস্তাধস্তিটা শুনতে পাই, মাথার মধ্যে
টেবিলে চেয়ার টেবিল চেয়ার টেবিল ভাঙছে রোজ
কে বলেছিল আমার ঘুমটা ধ্বজামার্কা, পুরনো-
একটা অভিযান খুলে আমি স্বপ্নের টীকা, টিপ্পনি
                    পড়ছিলাম-
মনে হচ্ছে শ্বেতপাথরের তৃনভূমিতে গরুগুলি
মোটা-মোটা লেজ দিয়ে মাছি তাডাচ্ছে-
বড়বাবু,অ্যাকাউন্ট্যাট বাবু বলে তারস্বরে গান
                বাজছে সাংস্কৃতিক উসবে
মূলতঃ প্রস্রাবাগারের
মধ্যে শব্দগুলি রেখে যাচ্ছি,পড়ো

নষ্ট করে দাও

টেলিফোনের রিং-এ কোনদিন দিদির মুখ দেখিনি
কিংবা রনজিতবাবুর দাঁড়ি গোঁফ-চশমা টশমা
হ্যাঁ ভালো থাকতেই তো চেষ্টা করি
ভালো কোন আটির্স্ট আমার মুখাবয়ব আঁকতে গিয়ে
ভীষন ফাঁপরে পড়ে, কথাবার্তার মধ্যে কথাবার্তার মধ্যে
আমার চোখটা কেমন যেন পাথর, নড়ে না চোখের পাতা
কোথায় ইনজেকশনের ব্যথা আর সেই বিখ্যাত ফুটো
কোথায় প্যাগোডা,গান,চিত্রকলা,মেঘ+ ও আকাশ
যেখানে আমি ভাল থাকতে চাই, হেসে ওঠার ঘটনা
আমার ছবিতে কিছুই থাকে না,
                  তার কিছুই দেখিনি এতকাল-
শুধু আঁকো আরশোলাময় কী এক গভীর রাতের
মধ্যে, মুখহীন টেলিফোন ও ঘোড়ার শুকনো হাঁটা-
থম্বোফোমের ছবি।

আরো পুরনো হবো

আমার কালো রঙের চশমার মাপ, আরো একটু পুরনো হবে
আরো একটু উন্মাদ হবে ভ্যানগখের বিশাল সূর্যটা
কাল মানে মাসের শেষদিন, বছরের শেষ দিন
তেলচিটে বাঁধানো দাঁতগুলো যুক্ত হয়ে বসে থাকবে
এখানে ওখানে, স্প্রিং ও মেটাল শুধু মাথা তুলবে
শক্ত এক বেড়াল থাকবে আমার চিন্তাভাবনায়
প্রাশ্চিক অগ্রনামেল আমোদ প্রমোদ নেশা ধূমপান
আজেবাজে ভালবাসার আরেক গ্রন্থ শুরু হবে

সুখদুঃখের যন্ত্রে কোন কাজ হচ্ছে না আর
ক্রমাগত আটকে যাচ্ছি এক পেণ্ডূলামে
স্ট্যাকাটো কবিতা লিখছি, হিম করমর্দন করছি
হিম, শক্ত মানুষগুলোর সঙ্গে, মাঝেমধ্যেই

ইংলিশ হাতা

আসো, আমরা পরস্পরের কাছে বন্ধ হয়ে থাকি
পোস্টকার্ড ইনল্যান্ডে একটা ছোট্ট দাগ-ও পড়বে না
ডাক যাবে আসবে, জ়িউজেনের ঢিব জমবে আমার
আমরা বাতাবির কথা ভেবে যাব যা শক্ত ও পেটা....
আমাদের কাছে আমরাই থাকব সব সময়....
বব্ধ হয়ে গুটিয়ে থাকবে বেণ্ডেড, রক্তের দাগ থাকবে না কোথাও,
আমদের কাতর চিতকার থেকে বেরিয়ে আসবে বন্ধ, মস্ত লক,
থাকবে না কোন স্বরধ্বনি বা অনুসর্গ আমাদের ভাষায়
আমদের আঁকা কোন ছবি থাকবে না এই বদ্ধতায়,
আমাদের বিশ্রাম, শুয়ে-থাকা কিংবা অনুভব
            করার মধ্যে রুদ্ধতার আঁটুনি থাকবে
আমাদের স্বপ্নে......... মলিবডেনামের চাপ আর...
            মলিন ইংলিশ হাতার পাহাড়-





ইমপেস্টো

হুইল চেয়ারের দুটো হাতল দেখতে পাই
দেখতে পাই স্টেইনলেস স্টিল
এদের কারোরই কোন সৌষ্ঠব নেই
আছে ভোঁতা কুড়ুল, শক্ত কাঠ, পিভিসির
                 আসবাব বেসিন
সেরি রিচার্ডস-এর বিমূঢ চোখ
                 রঙ করা ফুলের টব ও ঘড়ি
সবসময় হাতল বেরিয়ে আসছে আমাদের
কাজকর্ম ও অবসর থেকে, যাবতীয় পশুপক্ষী
ও বেড়ালের পেটের ভেতরে হিণ্ডেলিয়মের খাদ্য ও চামচ
যা আমাদের মধ্যে সবসময় বিক্রিয়া ঘটায়,
আমাদের কথাবার্তা সৌষ্ঠবহীন, অবিচ্ছিন্ন,
                 আমদের প্রিয় চেন-ও কলারপূর্ণ


ভুলে গেছে

আমার মাথার ওপরে সবসময় ব্যস্ত ফ্লাইওভার
আমি দ্রুত-হাঁটা মানুষ বা যুবতীদের কেউ নই
অথচ তাদের কাঁধের ব্যাগে শুয়ে আছে দক্ষিনের মুখ
আমি এ-মুখের জন্যে উঁচু নিচু পথ দিয়ে হাঁটি
তবু আমার-ই চারপাশে ওড়ে স্মৃতিহীন আমার-ই ব্লটিং

আমি তাতে ক্লান্তি ঘুম বিষন্নতা দিই
কারো সঙ্গে দেখা নেই কেবল আকাশের নীল ঝরে পড়ে
আমার দুঃখ আজ স্থির পাতার মত ওড়ে
মুছে যায় মহত্ত্ব বা মত্ততার দিন
ঝাঁপ দেয় আজ যেন দূর-থেকে-দেখা হাওড়ার ব্রীজ
একদিন তাকে নিয়ে বেড়াতে গিয়েছি সূদূর হাওড়ার গ্রামে
এখন তার কোন সৌন্দর্য নেই, ধুতুরা বিষের মত নামে

আমার-ই বিষাদ দিই তাকে
আকাশ ও নক্ষত্র-কে ঘুমের ট্যাবলেট খেতে দিই
হয়তো সে ভুলে গেছে এখন আমাকে

এখন

তখন মনোযোগী হইনিঃ হাত থেকে
এখন আঙুল খসে পড়ছে, কেউ বলে গেল-
হাঃ হাঃ অসময়ে এতগুলো দেবদারু পাতা বা ফেস্টুন-
বুঝিনি তখনও এরকম মিথ্যা থাকে
গাছে, পাতায়, পোষা পাখীদের ডাকে, দাড়ি গোঁফ ঠোঁট এবং মুখোশেরও
মুখোশ জনিত
কাজে কর্মে, কথায়, বর্শা,বর্মে,
যেমন আবৃত্তিকার, যে কবি ও পাঠক নয়,
৫ মিনিট নষ্ট করে, ৫ মিনিট দাঁদের ওষুধের
কাছে কাটেঃ ৫ মিনিট তুলে দিন আমার মৃত্যুতে।

   

গল্প

এবার বিশাল ঘুমের গল্প শুনাও।
ঘুম যা চৌকো টেবিলের ওপর থেকে
              নেমে আসবে চোখে
ঘুম যা শুদ্ধ করবে মন্দিরের দেবতা,পুরুত
বেড়া ডিঙিয়ে ঢোকা ছাগল ও মন্ত্রীদের,
লাইন বাঁধা গাড়ি, ঘুমিয়ে পড়বে গানের চিলিফিস
ঘুম নেমে আসুক বিজ্ঞ ও ধূর্ত পেঁচার গোল চোখে
কলকাতার, আধুনিকতার, ঘুম-
রেস্টোরেন্টের এঁটো কাপডিসে-
প্রত্যেকের মাকে দাও মর্মান্তিক ঘুম, ঘুমের গল্পে
               থাক ছুরি ও মাংসের গল্প
                                                    






মানুষ

কাঠের ওপর কাঠ মারা, কাঠের খিল-
হা-হা হেসে ভদ্রতার জলটুকু
         গামছায় মুছে নিল দিব্যেন্দু ঘোষ
সঙ্গে সঙ্গে মানুষ মানুষ কোলাহল কানে এল
মানুষই তো চালাচ্ছে টেপ এবং চেপে ধরছে
         মাইক্রোফোনের গলা
গভীর রাতের ঘুম অদ্ভুত মানুষটা বলে কথা বলে
কথা না তো, সিঁড়ি, না তো, চেয়ার, না তো, কাগজ
বুক চিতিয়ে অসংখ্য কুকুর
         গলায় মেডেল পড়ছে, অনন্তকাল
বাথরুমে গা ঢাকা দিয়ে সব শব্দ ও কবিতা
শুঁকে যাচ্ছে মানুষ, যার জিভে লাগছে মানুষের তেতো,
শ্বেতপাথর, কাঠের বোধবুদ্ধি, ঈর্ষা, ভালোবাসা
প্রান্তে যার প্রবেশ নেই কোনদিকে। শুধু কি প্রস্থান?

       
কমলালেবু
       
কমলালেবু ভেবে ধরলাম দুই ঠগের দুহাত-
জানি কমলালেবু স্বাস্থ্য ভালো রাখে
                   খেতেও সুস্বাদু-
ঠগের আঙুলগুলো আমাদের মতোই, মুখেও হাসিহাসি
দুটো ভারী বক্সিং গ্লাবস দুগালে বসেছে বুঝেছি
তোমাদের ফুলের টবে, এতদিনে লেবুগাছে ফুল এসে গেছে
হরিপদ ছিল; আজ গোটা রাস্তায় তাকেই খুঁজছি-
দেখতো এরা কারা, কারা এতদিন খুবলে খেয়েছে
মনে যে কিছু কিছু আনন্দ ছিল; খেয়েছে আমার
মূল্যবান, বেঁচে থাকার, সুটকেস; ঐ তো মাঠে
আমিই পড়ে আছি, ওই তো সেই অন্ধকার
করমচা গাছের নীচে, জামাকাপড়, কমলালেবুর
রসে, সিক্ত হয়ে, কোনদিন ফিরবো না ঘরে।
   
     




শূন্যতা

চার পাঁচজন মানুষ। একজন সেলাই করছে, সেলাই হচ্ছে না।
একজন কিছু দেখছে অথচ চোখে চিরদিনের মতো অন্ধ
কেউ সময় মাপছে অপেক্ষা দিয়ে। কেউ কথা বলছে। বোবা।
পুং-মিলন। ঘুম।
ঘুমিয়ে এসব করছে সবাই।
সিঁড়ি ঢুকছে ঘুমিয়ে।
খালি আপেলের প্লেটে আপেল-ঘুম। পাকস্থলীতে ঘুম।
ঘরের দা ও বঁটিতে ঘুম।
কনস্টানটিনপোলের ঘুম পড়ছে বারো বয়সের ছেলেটার ঘুমে।
কুকুরের চেনে ঘুম। ঘাড়ে ঘুম। অফিসে ঘুম।
ওয়াশিং মেশিনে ঘুম। জামা কাপড়ে ঘুম। একা
এক অন্ধকার, তারও, বিষাদ ও শূন্যতায় ঘুম



দুজন

১ নম্বর পাগল বলল আমি কান ধরে নিয়ে যাব আমাকে
২ নম্বর পাগল অসম্মতি জানাল। ২ নম্বর পাগল
ডান পায়ের জুতো দিয়ে বাঁ পায়ের জুতোকে পেটাল।
তারপর দুজনে আরো ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল।
১ নম্বর পাগল খড়কে দিয়ে ভেঙ্গে ফেল্ল শাবল।
২ নম্বর পাগল নিজের মাথা ঠুকলো নিজের
মাথার সঙ্গে; সমস্ত ইঁটে ঢুকিয়ে দিল ফাটল;
১ নম্বর বৃষ্টিকে ভাঙ্গল ভাঙ্গা ছাতা দিয়ে;
তারপর দুজনেই রাস্তার মাঝখানে পড়ে থাকল
১ নম্বর ও দু নম্বর দুটো গাড়ির চাকার নিচে




স্মৃতি

চারজন মহিলার চাহিদা ঢিব করে রাখা
           আর বাইশজন মানুষের
নীরবতা............
একজন বাড়তি মানুষ হলে দেখা যায়...
ফুল, মানুষ, মেয়ের রহস্য, ভাঙা-প্লেন
কোনো বিস্ময় নেই মেঘ, বৃষ্টির, যে শিশু হয়ে
দেখবো হাতের আঙুল বা ফাটাবো বেলুন
চমকে ওঠার আওয়াজ নেই; সেই সমস্যাটা
ইনস্ট্রুমেন্ট ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঠিক ফোকাসে
এনে ফেলেছি? নেই সে? অন্তত স্মৃতি?
গ্যাস-আভনের জগতে, প্লাস্টারের হাত?
আর অনেক মানুষের নীরবতা....?
দিনরাতের চাকাটা ঘুরিয়ে চলো যতদিন পারো

সেই সাদা রঙ

অনেক বলার পর, ভেসে ওঠো সেই সাদা রঙ,
যেখানে আঁচড় পড়েনি; লোভে এসে চাটেনি শরীর;
যাকে কেউ গ্রাহ্য করে না আজকাল।
দূরে থাকে শালবীথি, চোখ এসে পেরেক হয়ে গেঁথেছে
সারাদিন একান্ত অভ্যাসে। তাই তুমি ভোগ্য নও কারো।

কখনো ঘড়ির পাশে, পয়সার কাছে, ব্যবহারহীন অস্পষ্টতা যেমন,
কিছুটা লাল ও গোলাপী মেশানো কথাবার্তা নয়
নড়ে ওঠে অভিধানের বিপক্ষে যে স্পর্শকাতরতা
আকস্মিকভাবে। আজ যেন দেখা হয়, ঝরে যাও বুকে
নামহীন মানবপ্রকৃতি।

বাকী সব হট্টগোল; সার্কাসের হলুদ টূপির মত
দিন; হাসি,হাততালি,আসবাবের ধুম।
মনে পড়ে যায় তাই হিমাদ্রিকে যে এখন নেই,
যে রকম শাদা মানুষের হস্তাক্ষর ঢেকে দাও এখন আমাকে।



একা শুধু ঘুম থাক

তোমাদের মধ্যে আমার দুরারোগ্য অসুখ
তোমাদের মধ্যে আমার মৃত্যু
পার্ক স্ট্রীটকে বলো, একবার আসুক এই ঘরে
তারপর ভাঙো পথ, একবার শুধু ঘুম থাক
তোমাদের আঁধারে, তোমাদের স্মৃতির পাথরে


এই ঘর-২

আমাকে নিয়ে যেতে পারে না, এমন
ফলত একই ঘরে চাবুকে বিক্ষত হই

কেউ নেই বলে হাতে সূচ ফোঁটে রোজ
জীবনদায়ী ওষুধেও প্রান দিতে পারে না আমাকে

নিতান্ত সত্য কথা বলে যাব আজ এই দিন
ভালবাসা বলে কারও হৃদয়ে নেই সামান্য করুনা


জানে না

আমি হারিয়ে গিয়েছি ঃ এ-শহর দেখেছে? ব্যাকুলতা ও নিস্পৃহতা, আমার সন্ধান
জানো? ভাড়াটে ট্যাক্সির লাল শালু, সব রাস্তা জানো তুমি? জানো, নিঃসঙ্গতা এখন কোথায় বাড়ি ভাড়া করে আছে? একটা স্টলের বয় আমার ঘূনগুলি দেখতে চেয়েছিল। ঘৃনা তুমি কি তোমাকে দেখেছ? আমার বুকের পাটাতন ফাঁক হয়ে যাচ্ছে, বুক কি তা জানে? আমার জিভের নিচে ওষুধ, বাহুর মাংস, কখনও কি মর্গ দেখনি? আমার এই শূন্যস্থান কে রেখে গেছে , তাকে চেনো তুমি? পেথিডিন ইঞ্জেকশান ও আমি একসঙ্গে ঘুমাইনি বহুদিন। ঘুম, তুমি আমার ঘুম চেনো? যাবতীয় সুখাদ্য, জানো আমি এখন কোথায়? নারীর বক্রতা, তুমি জানো?

                    




নিজের কাছে

চারপাশে নিজেকে ফেলে ও ছড়িয়ে যাই
হয়তো অনেক অভ্যর্থনা থাকে, পাহাড়ের ফাঁকে
অথবা, রেলগেটের অন্ধকারে আজানু মুখোমুখি
                  দুটো মানুষের কন্ঠস্বর
তাদের উড়ন্ত মুখ
কেবল ছুঁয়ে যায়        কিছুটা নীরব হাওয়া
সাপের ফণা খেলে লোমযুক্ত শূন্যতা বরাবর
আমি এদেরই ধারেকাছে থাকি
                 ক্ষত বা ব্যথার অপব্যবহারে
নিয়োস্পোরিন থাকে যেন টেবিলে কোথাও না-খোলা
                         প্যাকেটে চিরদিন


জীবন কাটাতে কাটাতে

দুজন মহিলার মতো জীবন কাটাতে কাটাতে
ভারী শেকল ও কব্জার জঙ্গলে
আমার বৃষ্টিতেও কব্জা ও হ্যাসবল
যার ক্রমাগত ডেজার্টিফিকেশন
আমার চোখ খারাপ হলেও, আমার ভিসন
ধবধবে সাদা......
আর আমার গ্রয়েন ঠেকছে আমার শরীরের
সবখানে, রাস্তার লোকজনের মধ্যে ও হোমগার্ডের
হাতের লাঠিতে
ক্লান্ত এক দুঃখ ক্রমশ অসাড় করছে আমাকে
ওয়েস্টমিনিস্টার হল,ব্যাংক পাহাড় হয়ে উঠছে
বন্ধ্যা গাছপালা ফুটে উঠছে কুঠারের চোখে
বন্ধ্যা জলের গ্লাসে, আমি
চামড়ার ঢিবের মধ্যে চামড়া হয়ে যাচ্ছি
আমি, হাঁটু হয়ে যাচ্ছি