........বিহারীলাল
চক্রবর্ত্তী......
(কাব্যগ্রন্থ- ‘বঙ্গসুন্দরী’, ‘সঙ্গীত-শতক’, ‘সারদামঙ্গল ’,
‘মায়াদেবী ‘, ‘শরৎকাল’,’ধুমকেতু’,’দেবরানী’,
’বাউল বিংশতি’, ‘সাধের আসন’,’কবিতা ও সঙ্গীত’, ‘
নিসর্গ-সন্দর্শন’, ‘বন্ধু-বিয়োগ’ , ‘প্রেম-প্রবাহিনী’ , ‘স্বপ্ন-দর্শন’)
রবীন্দ্রনাথ তখন যুবক আর জ্যেষ্ঠ সহোদর
দ্বিজেন্দ্রনাথ বিহারীলালের একনিষ্ঠ
অনুরাগী।‘সঙ্গীত শতক’ পাঠে মুগ্ধ হয়ে তিনি বলতেন-“ বিহারীলালের হাড়ে হাড়ে
প্রাণে প্রাণে কবিত্ব ঢালা থাকিত। তাহার রচনা তাঁহাকে যত বড় কবি বলিয়া পরিচয়
দেয়,তিনি তাহা অপেক্ষাও অনেক বড় কবি ছিলেন।“ সেসময় ঠাকুরবাড়িতে আসত বিহারীলালের
‘অবোধবন্ধু’ নামক মাসিক পত্রিকা আর সেই অবোধবন্ধুর বন্ধুত্বেই কোথাও ধরা পড়েছিল
যুবক রবীন্দ্রনাথের সাদা কাগজের দরজাগুলো।তাঁর পরবর্তী জীবন ও শিল্পসাহিত্যের
প্রস্তাব ও পরিচিতির এই সেই ফুটনোট। সুদীর্ঘ দুপুরে দাদার বইয়ের আলমারী থেকে চুরি
করে পড়তেন ‘বঙ্গদর্শন’,’সংগীত-শতক’’,বা ‘সারদামঙ্গল’ এর মত বিহারীলালের
যুগোত্তীর্ণ সৃষ্টিগুলোকে। রবীন্দ্রনাথার সম্মোহিত দৃষ্টি, জীবন কোলাহলের
প্রেক্ষিতে বিহারীলালের মাঝেই কোথাও খুঁজে নিচ্ছিল আত্মসারাৎসসার,এক মনগ্র প্রস্তুতি।কবির নিজের সুর খুঁজে পাচ্ছিলেন
ভবিষ্যতের এক বিশ্বকবি। রবীন্দ্রনাথের নিজের কথাতেই-“বাংলা ভাষায় বোধ করি সেই প্রথম মাসিক
পত্র বাহির হইয়াছিল যাহার রচনার মধ্যে একটা স্বাদবৈচিত্র্য পাওয়া যাইত। বর্তমান
বঙ্গসাহিত্যের প্রাণসঞ্চারের ইতিহাস যাঁহারা পর্যালোচনা করিবেন তাঁহারা অবোধবন্ধুকে
উপেক্ষা করিতে পারিবেন না। বঙ্গদর্শনকে যদি আধুনিক বঙ্গসাহিত্যের প্রভাতসূর্য বলা
যায় তবে ক্ষুদ্রায়তন অবোধবন্ধুকে প্রত্যুষের শুকতারা বলা যাইতে পারে।“ রবীন্দ্রনাথের
প্রাথমিক বিকাশে বিহারীলালের প্রভাব বা
অনুপ্রেরনা অস্বীকার করা যায় না,ঠিক যেভাবে অস্বীকার করা যায় না বাংলা সাহিত্যের
দীর্ঘ ইতিহাসে বিহারীলালের উপস্থিতি।ভাষার অফুরান আলোকে সে যেন জেগে থাকার এক
অনুভূত উচ্চারন। রবীন্দ্রনাথের ‘বনফুল’, ‘ভগ্নহৃদয়’,বা ‘কবিকাহিনী’ তে হয়ত তাঁর
সুস্পষ্ট প্রভাবও রয়েছে কিন্তু বিহারীলাল প্রসঙ্গে এ তথ্য যতটা না প্রাসঙ্গিক তার
চেয়েও প্রাসঙ্গিক এক কবির একাধিক কবির প্রাণনা হয়ে ওঠা প্রেরণা হয়ে ওঠা বিষয়টি ,নির্ভরতা
ও নির্বাচন হয়ে ওঠার প্রসঙ্গটি।কেবল রবীন্দ্রনাথ নয়,সমসাময়িক উদীয়মান কবি ও
লেখকদের মধ্যে অধরলাল সেন, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি,রসময় লাহা,অক্ষয়কুমার বড়াল,নগেন্দ্রনাথ
গুপ্ত প্রমুখরা বিহারীলালের একনিষ্ঠ ভক্ত ছিল বলা চলে,অক্ষয়কুমার তাঁকে গুরু বলেও
মানতেন ঠিক যেমন রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলতেন ‘ভোরের পাখি’।এমনকি রবীন্দ্রনাথের
মানসচরিত্র গঠনে যে কাদম্বরী দেবীর উপস্থিতি অনস্বীকার্য ,তিনিও বিহারীলালের কবিতার
পরম ভক্ত ছিলেন, কবির নিজের কবিতারই কয়েক লাইন বুনে আসন করে উপহার দেন কাদম্বরী
দেবী। স্বাভাবিকভাবেই ‘সারদামঙ্গল’ বা ‘বঙ্গসুন্দরী’ এর মত কাব্যনাটিকাগুলো বার
বার রবীন্দ্রনাথের রসজ্ঞ মননে বিস্ময়ের
সঞ্চার করে যায়।১৩০১ সালে ‘সাধনা’ পত্রিকায় বিহারীলালের মৃত্যুর পর তাঁর প্রতি
এভাবেই ঋনস্বীকার করেছিলনে রবীন্দ্রনাথ।–“এমন নির্মল সুন্দর ভাষা, এমন ভাবের আবেগ,
কথার সহিত এমন সুরের মিশ্রণ আর কোথাও পাওয়া যায় না; বর্তমান সমালোচক এককালে
“বঙ্গসুন্দরী’ “সারদামঙ্গলে’র কবির নিকট হইতে কাব্যশিক্ষার চেষ্টা করিয়াছিল, কতদূর
কৃতকার্য হইয়াছে বলা যায় না, কিন্তু এই শিক্ষাটি স্থায়ীভাবে হৃদয়ে মুদ্রিত হইয়াছে
যে, সুন্দর ভাষা কাব্যসৌন্দর্যের একটি প্রধান অঙ্গ; ছন্দে এবং ভাষার সর্বপ্রকার
শৈথিল্য কবিতার পক্ষে সাংঘাতিক।“ বিহারীলাল
প্রসঙ্গে কবিগুরুকে টেনে আনার একটাই
যৌক্তিকতা,তা রবীন্দ্রনাথকে প্রকাশের নয় বরং অপ্রকাশিত, সাধারন্যে কবিতা প্রচারের
লালসাহীন এক ভাষাসন্ন্যাসীর সামান্যতম মূল্যায়ণের প্রচেষ্টা।যা কোথাও ভবিষ্যত কবির
প্রস্তুতি যা কোথাও জগৎ ঘুরে আসা চেতনার
এক অনন্য এককে ফিরে আসা।‘বঙ্গসুন্দরী’ র বিহারীলাল যখন বলেন- “ প্রিয়তম সখা
সহৃদয়!/প্রভাতের অরুণ উদয়,/হেরিলে তোমার পানে,/তৃপ্তি দীপ্তি আসে প্রাণে,/মনের
তিমির দূর হয়।“- তখন মনে হয় বাংলা কবিতারই এক সরল মুখ কোথাও বিহারীলালের চোখদুটিকে
আঘাত করছে সপ্রতিভ উড্ডীন থেকে।সাধু ভাষার মাঝেও কবিতার বিষয় ও প্রসঙ্গকে সেই যুগে
বিহারীলালই আধ্যাত্মিক অর্জনের পাশাপাশি
দিয়েছিলেন বস্তুজগতের বিবিধতা।তাঁর শ্লোকগুলি শরীরের ভেতরের তন্ময় ধ্যানকেই শ্রেষ্ঠতা
দেয়,সংগীতসুধা দেয়, শাসনকাল পেরিয়ে যেতে দেয় সংরক্ষনবাদীদের।‘সারদা-মঙ্গলে’ এও বিহারীলাল
দেবী স্বরস্বতীকে কেবল চিরায়ত ঈশ্বরী রূপে দেখেননি বরং সওয়াল জবাব করেছেন
অগ্রন্থিত প্রকারভেদগুলোর,বেছে নিয়েছেন ঈশ্বরীর অজুহাতে লুকিয়ে থাকা পৃথিবীর
মুখগুলো।জননী,কন্যা,প্রেয়সী এমনই বহুবিধ জীবনধারার বিণ্যাসে উঠে এসেছে এক
প্রচ্ছন্ন প্রমাণ, থাকার ভেতরেও আরও এক থাকা।বিহারীলালের মৃত্যুতে ‘চিকিৎসাতত্ত্ব-বিজ্ঞান এবং সমীরণ’ নামক মাসিকপত্রে প্রকাশিত
প্রবন্ধে লেখা হয়েছিল-“ সারদা-মঙ্গল বুঝিতে বিস্তৃত প্রাণ চাই। ‘সারদা-মঙ্গল’ কবি
ভিন্ন অন্যে বুঝিবে না। এইজন্য বলিতে হয়,বিহারীলাল কবির কবি”।
বিহারীলালের
প্রায় সব কটি কাব্যগ্রন্থকেই কাব্য নাটিকা বলা যেতে পারে,যার ফলে আলাদা আলাদা অংশ
পড়ে কবিতার সার্বিক বোধ উদ্ধার অনেকাংশেই অসম্ভব,তাই পাঠকের সম্পূর্ণ অনুচেতনার উৎসে পৌঁছতে এবং অবশ্যই পরিসরের স্বল্পতাকে মান্য দিয়ে
পূর্ণাঙ্গ ‘সারদা-মঙ্গল’’এই রইল একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে একশ বছর আগের এক কবির
অনুসন্ধান, এক কুয়াশা সূদূর সংবেদনের কাছে সামান্য হয়ে ওঠা-
সারদামঙ্গল
প্রথম সর্গ
----
গীতি
-১-
ললিত –আড়াঠেকা
ওই কে অমরবালা
দাঁড়ায়ে উদয়াচলে
ঘুমন্ত
প্রকৃতি-পানে চেয়ে আছে কুতুহলে!
চরন-কমলে লেখা
আধ আধ রবি-রেখা
সর্ব্বাঙ্গে
গোলাপ-আভা,সীমন্তে শুকতারা জ্বলে !
যোগে যেন পায়
স্ফূর্ত্তি,
সদয়া
করুণামূর্ত্তি,
বিতরেন হাসি
হাসি শান্তি সুধা ভূমণ্ডলে ।
হয় হয় প্রায়
ভোর,
ভাঙো ভাঙো
ঘুম-ঘোর
সুস্বপ্নরূপ্নী
উনি,উষারানী সবে বলে ।
বিরল তিমিরজাল,
শুভ্র অভ্র
লালে-লাল
মগন তারকারাজি
গগনের নীল জলে !
তরুণ-কিরণাননা
জাগে সব
দিগঙ্গনা,
জাগেন পৃথিবী
দেবী সুমঙ্গল কোলাহলে ।
এস মা উষার সনে
বীনাপাণি
চন্দ্রাননে,
রাঙা চরন
দু-খানি রাখ হৃদয়-কমলে !
-২-
কে তুমি
ত্রিদিবদেবী বিরাজ হৃদি-ক মলে !
নধর নগনা লতা
মগনা কমলদলে ।
মুখখানি ঢল ঢল,
আলুথালু কুনতল,
সনাল কমল দুটি হাসে
বাম করতলে !
-৩-
কপোলে সুধাংশু
ভাস,
অধরে অরুণ হাস,
নয়ন
করুণাসিন্ধু প্রভাতের তারা জ্বলে !
মাথা থুয়ে
পয়োধরে
কোলে বীণা খেলা
করে-
স্বর্গীয় অমিয়
স্বরে জানিনে কি কথা বলে !
-৪-
ভাব-ভরে
মাতোয়ারা
যেন
পাগলিনীপারা,
আহ্লাদে
আপনা-হারা মুগুধা মোহিনী,
নিশান্তের
শুকতারা,
চাঁদের সুধার
ধারা,
মানস-মরালী মম
আনন্দ-রূপিনী !
তুমি সাধনের
ধন,
জান সাধকের মন,
এখন আমার আর
কোন খেদ নাই মলে !
-৫-
নাহি চন্দ্র
সূর্য্য-তারা
অনল
হিল্লোল-ধারা,
বিচিত্র বিদ্যুৎ দাম
দ্যুতি ঝলমল;
তিমিরে নিমগ্ন
ভব ,
নীরব নিস্তব্ধ
সব,
কেবল মরুতরাশি
করে কোলাহল !
-৬-
হিমাদ্রি শিখর
পরে
আচম্বিতে আলা
করে
অপরূপ জ্যোতিং
ওই পূণ্য তপোবন !
বিকচ নয়নে চেয়ে
হাসিছে দুধের
মেয়ে,-
তামসী
–তরুণ-ঊষা কুমারীরতন ।
কিরণে ভুবন
ভরা,
হাসিয়ে জাগিল
ধরা,
হাসিয়ে জাগিল
শূন্যে দিগঙ্গনাগণ ।
হাসিল অম্বরতলে
পারিজাত দলে
দলে,
হাসিল মানস-সরে
কমল-কানন ।
-৭-
হরিনী মেলিল
আঁখি
নিকুঞ্জে
কূঞ্জিল পাখী,
বহ্ল সৌরভ মাখা
শীতল সমীর ।
ভাঙ্গিল মোহের
ভুল,
জাগিল মানবকূল,
হেরিয়ে তরুণ
উষা আনন্দে অধীর !
-৮-
অম্বরে
অরুণোদয়,
তলে দুলে দুলে
বয়
তমসা তটিনী
রানী কুলু কুলু স্বনে;
নিরখি লোচনলোভা
পুলিন
বিপিন-শোভা
ভ্রমেণ
বাল্মীকি মুনি ভাব-ভোলা মনে ।
-৯-
শাখি-শাখে
রস-সুখে
ক্রৌঞ্চ
ক্রৌঞ্চী মুখে মুখে
কতই সোহাগ করে
বসি দু-জনায়,
হানিল শবরে
বাণ,
নাশিল ক্রৌঞ্চের
প্রাণ,
রুধিরে আপ্লুত পাখা
ধরনী লুটায় !
-১০-
ক্রৌঞ্চী প্রিয়
সহচরে
ঘেরে ঘেরে শোক
করে,
অরণ্য পুরিল
তার কাতর ক্রন্দনে !
চক্ষে করি দরশন
জড়িমা -জড়িত
মন,
করুণ হৃদয় মুনি
বিহ্বলের প্রায়;
সহসা ললাটভাগে
জ্যোতির্ম্ময়ী কন্যা জাগে,
জাগিল বিজলী
যেন নীল নব ঘনে !
-১১-
কিরণে কিরণময়,
বিচিত্র
আলোকোদয়,
ম্রিয়মাণ
রবিচ্ছবি,ভুবন উজলে ।
চন্দ্র নয়,
সূর্য্য নয়,
সমুজ্জল
শান্তিময়,
ঋষির ললাটে আজি
না জানি কি জ্বলে !
-১২-
কিরণ-মণ্ডলে
বসি
জ্যোতির্ম্ময়ী
সুরূপসী
যোগীর ধ্যানের
ধন ললাটিকা মেয়ে ;
নামিলেন ধীর
ধীর,
দাঁড়ালেন হয়ে
স্থির,
মুগ্ধ নেত্রে
বাল্মীকির মুখ-পানে চেয়ে !
-১৩-
করে
ইন্দ্রধনুবালা,
গলায় তারার
মালা,
সীমন্তে
নক্ষত্র জ্বলে, ঝলমলে কানন,
কর্ণে কিরণের
ফুল,
দোদুল চাঁচর
ঢুল
উড়িয়ে ছড়িয়ে
পড়ে ঢাকিয়ে আনন !
-১৪-
হাসি-হাসি
শশি-মুখা,
কতই কতই সুখী!
মনের মধুর
জ্যোতিঃ উছলে নয়নে ।
কভু হেসে ঢল
ঢল,
কভু রোষে
জ্বলজ্বল,
বিলোচন ছলছল
করে প্রতিক্ষণে !
-১৫-
করুণ
ক্রন্দন-রোল,
উত উত উতরোল,
চমকি বিহ্বলা
বালা চাহিলেন ফিরে;
হেরিলেন
রক্ত-মাখা
মৃত ক্রৌঞ্চ
ভগ্ন-পাখা,
কাঁদিয়ে
কাঁদিয়ে ক্রৌঞ্চী ওড়ে ঘিরে ঘিরে !
-১৬-
একবার সে
ক্রৌঞ্চীরে,
আর বার
বাল্মীকিরে
নেহারেন ফিরে
ফিরে, যেন উন্মাদিনী !
কাতরা করুণা
ভরে,
গান সকরুণ
স্বরে,
ধীরে ধীরে বাজে
করে বীণা বিষাদিনী !
-১৭-
সে শোক-সংগীত
কথা
শুনে কাঁদে
তরু-লতা,
তমসা আকুল হয়ে
কাঁদে উভরায় !
নিরখি
নন্দিনীছবি
গদগদ আদি কবি-
অন্তরে
করুণা-সিন্ধু উথলিয়া ধায়
-১৮-
রোমাঞ্চিত
কলেবর,
টলমল থরথর,
প্রফুল্ল কপোল
বহি বহে অশ্রুজল !
হে যোগেন্দ্র !
যোগাসনে
ঢুলু ঢুলু
দু-নয়নে
বিভোর বিহ্বল
মনে কাঁহারে ধেয়াও ?
কমলা ঠমকে হাসি
ছড়ান রতনরাশি,
অপাঙ্গে
ভ্রূ-ভঙ্গে আহা ফিরে নাহি চাও !
ভাবে ভোলা খোলা
প্রাণ,
ইন্দ্রাসনে
তুচ্ছ জ্ঞান,
হাসিয়ে পাগল
বলে পাগল সকল !
-১৯-
এমন করুণা মেয়ে
আছে যাঁর মুখ
চেয়ে
ছলিতে এসেছ
তাঁরে কেন গো চপলা?
হেরে কন্যা
করুণায়
শোক তাপ দূরে
যায়,-
কি কাজ-কি কাজ
তাঁর তোমায় কমলা !
-২০-
এস মা
করুণা-রানী,
ও বিধূ-বদনখানি
হেরি
,হেরি,আঁখি ভরি হেরি গো আবার !
শুনে সে উদার
কথা-
জুড়াক মনের
ব্যথা,
এস আদরিনী বানী
সমুখে আমার !
যাও লক্ষী
অলকায়,
যাও লক্ষী
অমরায়,
এস-না এ
যোগি-জন-তপোবনে আর !
-২১-
ব্রহ্মার
মানস-সরে
ফুটে ঢলঢল করে
নীল জলে মনোহর
সুবর্ণ-নলিনী,
পাদপদ্ম রাখি
তায়
হাসি হাসি ভাসি
যায়
ষোড়শী রূপসী
বামা পূর্ণিমা যামিনী !
-২২-
কোটি শশী
উপহাসি
উথলে
লাবন্যরাশি,
তরল দর্পণে যেন
দিগন্ত আবরে;
আচম্বিতে অপরূপ
রূপসীর
প্রতিরূপ
হাসি হাসি ভাসি
ভাসি উদয় অম্বরে !
-২৩-
ফটিকের নিকেতন,
দশ দিকে দরপণ,
বিমল সলিল যেন
করে তক তক;
সুন্দরী
দাঁড়ায়ে তায়
হাসিয়ে যে দিকে
চায়,
সেই দিকে হাসে
তার কুহকিনী ছায়া।
নয়নের সঙ্গে
সঙ্গে
ঘুরিয়া বেড়ায়
রঙ্গে,
অবাক দেখিলে,হয়
অমনি অবাক; চক্ষে পড়ে না পলক !
তেমনি মানস-সরে
লাবণ্য দর্পন
ঘরে
দাঁড়ায়ে
লাবণ্যময়ী দেখিছেন মায়া ।-
-২৪-
যেন তাঁরে হেরি
হেরি,
শূন্যে শূন্যে
ঘেরি ঘেরি,
রূপসী চাঁদের
মালা ঘুরিয়া বেড়ায়;
চরন-কমল-তলে
নীল নভ নীল জলে
কাঞ্চন-কমলরাজি
ফুটে শোভা পায় !
-২৫-
চাহিয়ে তাঁদের
পানে
আনন্দ ধরে না
প্রাণে,
আনত আননে হাসি
জল-তলে চান;
তেমনি
রূপসী-মালা
চারি দিকে করে
খেলা,
অধরে মৃদুল
হাসি আনত বয়ান !
-২৬-
রূপের ছটায়
ভুলি,
শ্বেত শতদল
তুলি
আদরে পরাতে যান
সীমন্তে সবার;
তাঁরাও তাঁহারি
মত
পদ্ম তুলি
যুগপত
পরাতে আসেন সবে
সীমন্তে তাঁহার ।
-২৭-
অমনি স্বপন
প্রায়
বিভ্রম
ভাঙ্গিয়া যায়,
চমকি আপন-পানে
চাহেন রূপসী ।
চমকে গগনে
তারা,
ভূধরে
নির্ঝর-ধারা,
চমকে চরন-তলে
মানস সরসী ।
-২৮-
কুবলয় –বনে বসি
নিকুঞ্জ-শারদ-শশী
ইতস্তত শত শত
সুর-সীমন্তিনী
সঙ্গে সঙ্গে
ভাসি যায়,
অনিমেষে দেখে
তায়,
যোগাসনে যেন সব
বিহ্বলা যোগিনী !
-২৯-
কিবে এক পরিমল
বহে বহে অবিরল
!
শান্তিময়ী
দিগঙ্গনা দেখেন উল্লাসে ।
শূন্যে বাজে
লীনা বাঁশী,
সৌদামিনী ধায়
হাসি,
সংগীত অমৃত
রাশি উথলে বাতাসে !
তীরে ঘোড়া,ষোড়
করে
অমর কিন্নর নরে
সমস্বরে স্তব
করে, ভাসে অশ্রুজলে-
অমর কিন্নর নরে
ভাসে অশ্রুজলে !
-৩০-
তোমারে হৃদয়ে
রাখি-
সদানন্দ মনে
থাকি,
শ্মশান অমরাবতী
দু-ই ভাল লাগে;
গিরিমালা ,
কুঞ্জবন,
গৃহ,নাট-নিকেতন,
যখন যেখানে
যাই, যাও আগে আগে।
জাগরনে জাগ
হেসে,
ঘুমালে ঘুমাও
শেষে,
স্বপনে
মন্দার-মাল পরাইয়ে দাও গলে !
-৩১-
যত মনে অভিলাষ,
তত তুমি
ভালবাস,
তত মন প্রাণ
ভোরে আমি ভালবাসি;
ভক্তি ভাবে এক
তানে
মজেছি তোমার
ধ্যানে;
কমলার ধন-মানে
নহি অভিলাষী ।
থাক হৃদে জেগে
থাক,
রূপে মন ভোরে
রাখ,
তপোবনে ধ্যানে
থাকি এ-নগর কোলাহলে !
-৩২-
তুমিই মনের
তৃপ্তি,
তুমি নয়নের
দীপ্তি
তোমা-হারা হলে
আমি প্রাণ-হারা হই;
করুণা –কটাক্ষে
তব
পাই প্রাণ
অভিনব,-
অভিনব
শান্তিরসে মগ্ন হয়ে রই!
যে কদিন আছে
প্রাণ,
করিব তোমায়
ধ্যান,
আনন্দে ত্যেজিব
তনু ও রাঙা চরন তলে !
-৩৩-
অদর্শন হলে
তুমি,
ত্যজি লোকালয়
ভূমি,
অভাগা বেড়াবে
কেঁদে নিবিড় গহনে;
হেরে মোরে
তরু-লতা
বিষাদে কবে না
কথা,
বিষন্ন
কুসুমকুল বন-ফুল-বনে !
‘হা দেবী,হা
দেবী,’ বলি
গুঞ্জরি
কাঁদিবে অলি;
নীরবে
হরিনীবালা ভাসিয়ে নয়ন-জলে !
-৩৪-
নির্ঝর ঝর্ঝর
রবে
পবন পূরিয়ে যবে
আঘোষিবে
সুরপুরে কাননের করুণ ক্রন্দন-হাহাকার,
তখন টলিবে হায়
আসন তোমার,-
হায় রে, তখন
মনে পড়িবে তোমার !
হেরিবে কাননে
আসি
অভাগার
ভস্মরাশি,
অথবা হাড়ের
মালা, বাতাসে ছড়ায়;
করুণা জাগিবে
মনে-
ধারা ববে
দু-নয়নে,
নীরবে দাঁড়ায়ে
রবে, প্রতিমার প্রায় !
-৩৫-
ভেবে সে শোকের
মুখ –
বিদরে আমার
বুক,
মরিতে পারিনে
তাই আপনার হাতে;
বেঁধে মারে, কত
সয় !
জীবন
যন্ত্রনাময়-
ছারখার চুরমার
বিনি বজ্রঘাতে !
অন্তরাত্মা জর
জর,
জীর্ণারণ্য
চরাচর,
কুসুম-কানন-মন
বিজন শ্মশান !
কি করিব, কোথা
যাব ,
কোথা গেলে দেখা
পাব,
হৃদি-কমল-বাসিনী
কোথা রে আমার?
কোথা সে
প্রাণের আলো,-
পূর্ণিমা-চন্দ্রিমা-জাল,
কোথা সেই সুধা
মাখা সহাস বয়ান?
কোথা গেলে
সঞ্জীবনী?
মণি-হারা মহা
খনি-
অহো ! সেই
হৃদি-রাজ্য কি ঘোর আঁধার!
তুমি তো পাষাণ
নও,
দেখে কোন
প্রাণে সও?
অয়ি,সুপ্রসন্ন
হও কাতর পাগলে !
------------
দ্বিতীয় সর্গ
----
গীতি
রাগিনী
কালাংড়া- তাল যৎ
হারায়েছি-হারায়েছি
রে, সাধের স্বপনের ললনা !
মানস – মরালী
আমার কোথা গেল বল না !
কমল-কাননে
বালা,
করে কত
ফুল-খেলা,
আহা, তার মালা
গাঁথা হল না !
প্রিয়
ফুলতরুগণ,
সুধাকর, সমীরন,
বল,বল,ফিরে কি
আর পাব না?
কেন এল চেতনা !
---------------
-১-
আহা সে পুরুষবর
না জানি কেমনতর,
দাঁড়ায়ে
রজতগিরি অটল সুধীর !
উদার ললাট ঘটা,
লোচনে
বিজলী-ছটা,
নিটোল বুকের
পাটা, নধর শরীর ।
-২-
সৌম্যমূর্ত্তি
স্ফুর্তি ভরা,
পিঙ্গল বল্কল
পরা,
নীরদ-তরঙ্গ-লীলা
জটা মনোহর;
শুভ্র অভ্র
উপবীত
উরস্থলে
বিলম্বিত,
যোগপাটা
ইন্দ্রধনু বাজিছে সুন্দর ।
-৩-
কুসুমিতা লতা
ভালে,
শ্মশ্রুরেখা
শোভে গালে,
করেতে অপূর্ব্ব
এক কুসুম-রতন;
চাহিয়ে
ভুবন-পানে
কি যেন
উদয়-প্রাণে,
অধরে ধরে না
হাসি-শশীর কিরণ !
-৪-
কি এক বিভ্রম
ঘটা,
কি এক বদন ছটা,
কি এক উছলে
অঙ্গে লাবণ্য-লহরী !
মন্দাকিনী আসি
কাছে
থমকে দাঁড়ায়ে
আছে,
থ মকে দাঁড়ায়ে
দেখে অমর অমরী !
-৫-
নধর মন্দারাজি
নবীন পল্লবে
সাজি-
দূরে দূরে ধীরে
ধীরে ঘেরিয়ে দাঁড়ায়,
গরজি গভীর
স্বরে
জলধর শিরপরে
করি করি
জয়ধ্বনি চলে দুলে দুলে ।
তড়িত ললিত বালা
করে লুকোচুরি
খেলা,
সহসা সম্মুখে
দেখে চমকে পালায় !
অপ্সরা বাঁশরী
করে
দাঁড়ায়ে শিখরী
পরে,
আনন্দে-বিজয়-গান-গায়-প্রাণ
খুলে ।
-৬-
দিগঙ্গনা
কুতূহলে
সমীর-হিল্লোল-ছলে
বরষে মন্দার
ধারা আবরি গগন ।
আমোদে আমোদময়,
অমৃত উথলে বয়,
ত্রিদশ-আলয় আজি
আনন্দে মগন ।
জ্যোতির্ম্ময়
সপ্ত ঋষি
প্রভায় উজলি
দিশি,
সম্ভ্রমে
কুসুমাঞ্জলি, অর্পিছেন পদতলে ।
-৭-
সে মহাপুরুষ –
মেলা,
সে
নন্দনবন-খেলা,
সে
চির-বসন্ত-বিকশিত ফুলহার,
কিছুই হেথায়
নাই;
মনে মনে ভাবি
তাই,
কি দেখে আসিতে
মন সরিবে তোমার !
-৮-
কেমনে বা তোমা
বিনে
দীর্ঘ দীর্ঘ
রাত্র দিনে
সুদীর্ঘ জীবন
জ্বালা সব অকাতরে !
কার আর মুখ
চেয়ে-
অবিশ্রাম যাব
বেয়ে
ভাসায়ে তনুর
তরী অকূল সাগরে !
-৯-
কেন গো
ধরনী-রানী
বিরস বদনখানি ?
কেন গো বিষন্ন
তুমি উদার আকাশ ?
কেন প্রিয় তরু
লতা,
ডেকে নাহি কহ
কথা?
কেন রে
হৃদয়-কেন শ্মশান-উদাস ?
-১০-
কোন সুখ নাই
মনে,
সব গেছে তার সনে;’
খোলো হে অমরগণ
স্বরগের দ্বার !
বল, কোন
পদ্মবনে
লুকায়েছে
সংগোপনে?-
দেখিব কোথায় আছে
সারদা আমার!
-১১-
অয়ি, এ কি,
কেন, কেন,
বিষন্ন হইলে
হেন?
আনত
আনন-শশী,আনত নয়ন,
অধরে মন্থরে
আসি
কপোলে মিলায়
হাসি,
থর থর ওষ্ঠোধর,
স্ফোরে না বচন ।
-১২-
তেমন অরুণ রেখা
কেন কুহেলিকা
ঢাকা,
প্রভাত-প্রতিমা
আজি কেন গো মলিন ?
বল, বল,
চন্দ্রাননে
কে ব্যথা দিয়েছে
মনে,
কে এমন-কে একন
হৃদয়-বিহীন!
-১৩-
বুঝিলাম
অনুমানে,
করুণা-কটাক্ষ-দানে
চাবে না আমার
পানে,কবেও না কথা !
কেন যে কবে না,
হায়,
হৃদয় জানিতে
চায়,
সরমে কি বাধে
বানী,মরমে বা বাজে ব্যথা !
-১৪-
যদি
মর্ম্ম-ব্যথা নয়,
কেন অশ্রুধারা
বয়?
দেববালা ছল-কলা
জানে না কখন ;
সরল মধুর প্রাণ,
সতত মুখেতে
গান,
আপন বীনার তানে
আপনি মগন !
-১৫-
অয়ি, হা, সরলা
সতী
সত্যরূপা
সরস্বতী !
চির-অনুরক্ত
ভক্ত হয়ে কৃতাঞ্জলি
পদ-পদ্মাসন
কাছে
নীরবে দাঁড়ায়ে
আছে-
কি করিবে,কোথা
যাবে,দাও অনুমতি !
স্বরগ-কুসুম-মালা,
নরক-জ্বলন-জ্বালা,
ধরিবে প্রফুল্লমুখে
মস্তকে সকলি ।
তব আজ্ঞা
সুমঙ্গল,
যাই যাব রসাতল,
চাই নে এ
বরমালা, এ অমরাবতী !
-১৬-
নরকে নারকী-দলে
মিশিগে মনের
বলে,
পরাণ কাতর হলে
ডাকিব তোমায়;
যেন দেবী
সেইক্ষণে-
অভাগারে পড়ে
মনে,
ঠেল না চরণে
দেখো, ভুল না আমায় !
-১৭-
অহহ! কিসের তরে
অভাগা নরকে
জরে,
মরু-মরু-মরুময়
জীবন লহরী !
এ বিরস
মরূভূমে-
সকলি আচ্ছন্ন
ধূমে,
কোথাও একটিও আর
নাহি ফোটে ফুল !
কভু মরীচিকা
মাঝে
বিচিত্র কুসুম
রাজে,
উঃ ! কি বিষম
বাজে, যেই ভাঙে ভুল !
এত যে
যন্ত্রনা-জ্বালা ,
অবমান,অবহেলা,
অবু কেন প্রাণ
টানে ! কি করি, কি করি !
-১৮-
তেমন আকৃতি ,
আহা,
ভাবিয়ে ভাবিয়ে
যাহা-
আনন্দে উন্মত্ত মন, পাগল পরাণ;
সে কি গো এমন
হবে,
মোর দুখে সুখে
রবে,
কাঁদিয়ে ধরিলে
কর, ফিরাবে বয়ান ?
-১৯-
ভাবিতে পারিনে
আর !
অন্ধকার-অন্ধকার-
ঝটিকার ঘূর্ণি
ঘোরে মাথার ভিতর!
তরঙ্গিয়া
রক্তরাশি
নাকে মুখে চোখে
আসি
বেগে যেন ভেঙে ফেলে;
ধর,ধ র,ধর !-
-২০-
ধর আত্মা,
ধৈর্য্য ধর,
ছি ছি ! একি কর
কর,
মর যদি , মরা
চাই মানুষের মত !
থাকি বা
প্রিয়ার বুকে,
যাই বা
মরণ-মুখে,
এ আমি,আমিই রব;
দেখুক জগত ।
-২১-
মহান মনেরি তরে
জ্বালা জ্বলে
চরাচরে,
পুড়ে মরে
ক্ষুদ্রেরাই পতঙ্গের প্রায় !
জ্বলুক যতই
জ্বলে,
পর জ্বালা-মালা
গলে,
নীলকন্ঠ –কন্ঠে
জ্বলে হলাহল দ্যুতি !
হিমাদ্রিই
বক্ষপরে
সহে ব্রজ
অকাতরে !
জঙ্গল জ্বলিয়া
যায় লতায় পাতায় !
অস্তাচলে চলে
রবি,
কেমন প্রশান্ত
ছবি !
তখনো কেমন আহা
উদার বিভূতি।
-২২-
হা ধিক অধীর
হেন !
দেখেও দেখ না
কেন
দুখে দুখী অশ্রুমুখী
প্রাণ-প্রতিমায় !
প্রণয় পবিত্র
ধনে
সন্দেহ করো না
মনে,-
নাগরদোলায় দোলা
শিশুরি মানায় ।
সারদা সরলা
বালা,
সবে না সন্দেহ
জ্বালা,
ব্যথা পাবে
সুকোমল হৃদয়-কমলে !
------------
তৃতীয় সর্গ
----
গীতি
রাগিনী
বিভাস-তাল আড়াঠেকা
বিরাজ সারদে
কেন এ ম্লান কমলবনে !
আজো কিরে
অভাগিনী ভালবাস মনে মনে !
মলিন নলিন বেশ,
মলিন চিকণ কেশ,
মলিন মধুর
মূর্ত্তিম, হাসি নাই চন্দ্রাননে !
মলিন কমল-মালা,
মলিন
মৃণাল-বালা,
আর সে অমৃত
জ্যোতি জ্বলেনাক বিলোচনে !
চির আদরিনী
বীণা,
কেন, যেন
দীনহীনা
ঘুমায়ে পায়ের
কাছে পড়ে আছে অচেতনে !
জীবন-কিরণ-রেখা
অস্তাচলে দিল
দেখা,
এ হৃদি-কমল
দেবী ফুটিবে না আর !
যাও বীণা লয়ে
করে,
ব্রহ্মার
মানস-সরে,
রাজহংস কেলি
করে সুবর্ণ নলিনী-সনে ।
-------------
-১-
আজি এ বিষন্ন
বেশে
কেন দেখা দিলে
এসে,
কাঁদিলে,কাঁদালে,দেবী,জন্মের
মতন !
পূর্ণিমা-প্রমোদ-আলো,
নয়নে লেগেছে
ভাল;
মাঝেতে উথলে
নদী, দু পারে দু জন-
চক্রবাক
চক্রবাকী দু-পারে দু-জন !
-২-
নয়নে নয়নে
মেলা,
মানসে মানসে
খেলা,
অধরে প্রেমের
হাসি বিষাদে মলিন;
হৃদয়-বীনার
মাঝে
ললিত রাগিনী
বাজে,
মনের মধুর গান
মনেই বিলীন !
-৩-
সেই আমি, সেই তুমি,
সেই এ
স্বরগ-ভূমি,
সেই সব
কল্পতরু, সেই কুঞ্জবন;
সেই প্রেম,সেই
স্নেহ,
সেই প্রাণ, সেই
দেহ,-
কেন মন্দাকিনী
–তীরে দু-পারে দু জন !
-৪-
আকুল ব্যাকুল
প্রাণ,
মিলিবারে
ধাবমান;
কেন এসে অভিমান
সমুখে উদয়!-
কান্তি-শান্তি-ময়
তনু,
অপরূপ
ইন্দ্রধনু,
তেজে যেন জ্বলে
মন,অটল হৃদয় !
-৫-
কাতর পরাণ পরে
চেয়ে আছে
স্নেহভরে,
নয়ন-কিরণ যেন
পীযুষ লহরী;
এমন পদার্থে
হেলি
যাব না, যাব না
ঠেলি
উভয় সঙ্কটে আজ
মরি যদি, মরি !
-৬-
কেন গো পরের
করে
সুখের নির্ভর
করে,
আপনা আপনি সুখী
নহে কেন নর?
সদাশিব
সদানন্দ,
সতী বিনে
নিরানন্দ,
শ্মশানে ভ্রমেন
ভোলা খেপা দিগম্বর !
-৭-
হৃদয়-প্রতিমা
লয়ে
থাকি থাকি সুখী
হয়ে,
অধিক সুখের আশা
নিরাশা শ্মশান !
ভক্তিভাবে সদা
স্মরি,
মনে মনে পূজা
করি,
জীবন-কুসুমাঞ্জলি
পদে করি দান ।
-৮-
বাসনা বিচিত্র
ব্যোমে
খেলা করে রবি
সোমে
পরিয়ে নক্ষত্র
তারা হীরকের হার,
প্রগাঢ়
তিমিররাশি
ভুবন ভরেছে
আসি,-
অন্তরে জ্বলিছে
আলো, নয়নে আঁধার !
-৯-
বিচিত্র এ মত্ত
দশা-
ভাব ভরে যোগে
বসা,
হৃদয়ে উদার
জ্যোতি কি বিচিত্র জ্বলে !
কি বিচিত্র
সুর-তান
ভরপুর করে
প্রাণ,
কে তুমি গাহিছ
গান আকাশ-মন্ডলে !
-১০-
জ্যোতির প্রবাহ
মাঝে
বিশ্ববিমোহিনী
রাজে,
কে তুমি
লাবণ্য-লতা মূর্ত্তি মধুরিমা !
মৃদু মৃদু হাসি
হাসি
বিলাও
অমৃতরাশি,
আলোয় করেছ আলো
প্রেমের প্রতিমা !
-১১-
ফুটে ফুটে
অবিরল
হাসে হাসে
শতদল,
অবিরল
গুঞ্জরিয়ে ভ্রমর বেড়ায়;
সমীর সুরভিময়
সুখে ধীরে ধীরে
বয়
লুটায়ে চরণ-তলে
স্তুতি গান গায় !
-১২-
আচম্বিতে এ কি
খেলা !
নিবিড় নীরদমেলা
!
হা হা রে,
লাবণ্য বালা লুকাল, লুকাল !
এমন ঘুমের
ঘোরে-
জাগালে কে জোর
কোরে ?
সাধের স্বপন
আহা !-ফুরাল,ফুরাল !
-১৩-
বসন্তের
বনমালা,
ঘুমের রূপের
ডালা,
মায়ার মোহিনী
মেয়ে স্বপন সুন্দরী !
মনের
মুকুর-তলে,
পশিয়ে ছায়ার
ছলে,
কর কত লীলা-খেলা
!-কতই লহরী !
-১৪-
কোথা থেকে এস
তারা,
মাখিয়ে
সুধার ধারা,
জুড়াতে কাতর
প্রাণ নিতান্ত সময়ে !
(লয়ে পশু পক্ষী
প্রানী
ঘুমায় ধরনী-রনী,)
ঘুমায় ধরনী-রনী,)
কোথাও চলিয়ে
যাও অরুণ উদয়ে !
-১৫-
ফের এ কি আলো
এল !
কই, কই , কোথা
গেল,
কেন এল, দেখা
দিল, লুকাল আবার?
কে আমারে অবিরত
খেপায় খেপার মত
জীবন-কুসুম-লতা
কোথা রে আমার !
-১৬-
কোথা সে
প্রাণের পাখী,
বাতাসে ভাসিয়ে
থাকি-
আর কেন গান
কোরে ডাকে না আমায় !
বল দেবী
মন্দাকিনী,
ভেসে ভেসে
একাকিনী
সোনামুখী
তরীখানি গিয়েছে কোথায়?
-১৭-
এই না তোমারি
তীরে
দেখা আমি পেনু
ফিরে,
তুলে কেন না রাখিনু
বুকের ভিতরে !
হা ধিক রে
অভিমান,
গেল,গেল,গেল
প্রাণ,
করাল কালিমা ওই
গ্রাসে চরাচরে !
-১৮-
হারায়ে
নয়ন-তারা
হয়েছি জগত-হারা
ক্ষণে ক্ষণে
আপনারে হারাই হারাই !
ওহে ভাই, দাও
বোলে,
কোন দিকে যাব
চোলে,
ও কি ওঠে
জ্বোলে জ্বোলে?-কোথায় পালাই !
-১৯-
ও কি ও , দারুণ
শব্দ,
আকাশ পাতাল
স্তব্ধ !
দারুণ আগুন
সুদু ধূ-ধূ-ধূ-ধূ ধায় !
তুমুল তরঙ্গ
ঘোর,
কি ঘোর ঝড়ের
জোর,
পাঁজর ঝাঁজর
মোর দাঁড়াই কোথায় !
-২০-
তবে কি সকলি
ভুল?
নাই কি প্রেমের
মূল?-
বিচিত্র-গগন-ফুল
কল্পনা-লতার?
মন কেন রসে
ভাসে-
প্রাণ কেন
ভালবাসে
আদরে
পরিতে গলে সেই ফুল-হার ?
-২১-
শত শত নর-নারী
দাঁড়ায়েছে সারি
সারি,
নয়ন খুঁজিছে
কেন, সেই মুখখানি?
হেরে হারা-নিধি
পায়,
না হেরিলে
প্রাণ যায়,
এমন সরল সত্য
কি আছে না জানি !
-২২-
ফুটিলে প্রেমের
ফুল
ঘুমে মন ঢুল
ঢুল,
আপন সৌরভে
প্রাণ আপনি পাগল;
সেই স্বর্গ
সুধা পানে
কত যে আনন্দ
প্রাণে,,
অমায়িক
প্রেমিকে তা জানেন কেবল ।
-২৩-
নন্দন-নিকুঞ্জবনে
বসি শ্বেত
শিলাসনে,
খোলা প্রানে
রতি –কাম বিহরে কেমন !
আননে উদার
হাসি,
নয়নে অমৃতরাশি,
অপরূপ আলো এক
উজলে ভুবন !
-২৪-
পারিজাত মালা
করে,
চাহি চাহি
স্নেহভরে
আদরে পরসপরে
গলায় পরায়;
মেজাজ গিয়েছে
খুলে,
বসেছে দুনিয়া
ভুলে,
সুধার সাগর যেন
সমুখে গড়ায় !
-২৫-
কি এক ভাবেতে
ভোর,
কি যেন নেশার
ঘোর,
টলিয়ে ঢলিয়ে
পড়ে নয়নে নয়ন;
গলে গলে
বাহুলতা,
জড়িমা-জড়িত
কথা,
সোহাগে সোহাগে
রাগে গল-গল মন!
-২৬-
করে কর থরথর,
টলমল কলেবর,
গুরু গুরু দুরু
দুরু বুকের ভিতর;
তরুন অরুণ ঘটা
আননে আরক্ত
ছটা,
অধ র-কমল দল
কাঁপে ধরথর !
-২৭-
প্রণয় পবিত্র
কাম,
সুখ-স্বর্গ-মোক্ষ-ধাম!
আজি কেন হেরি
হেন মাতোয়ারা বেশ !
ফুলধনু ফুলছড়ি
দূরে যায়
গড়াগড়ি;
রতির খুলিয়ে
খোঁপা আলুথালু কেশ !
-২৮-
বিহ্বল পাগল
প্রাণে
চেয়ে সতী
পতি-পানে,
গলিয়ে গড়িয়ে
কোথা চলে গেছে মন;
মুগ্ধ মত্ত
নেত্র দুটি,
আধ ইন্দীবর
ফুটি,
দুলু দুলু ঢুলু
ঢুলু করিছে কেমন!
-২৯-
আলসে উঠিছে
হাই,
ঘুম আছে, ঘুম
নাই,
কি যেন
স্বপন-মত চলিয়াছে মনে;
সুখের সাগরে
ভাসি
কিবে প্রাণ
খোলা হাসি!
কি এক লহরী
খেলে নয়নে নয়নে!
-৩০-
উথুলে উথুলে
প্রাণ
উঠিছে ললিত
তান,
ঘুমায়ে ঘুমায়ে
গান গায় দুই জন;
সুরে সুরে সম
রাখি
ডেকে ডেকে ওঠে
পাখি,
তালে তালে ঢলে
ঢলে সমীরণ !
-৩১-
কুঞ্জের আড়াল
থেকে
চন্দ্রমা
লুকায়ে দেখে,
প্রণয়ীর সুখে
সদা সুখী সুধাকর।
সাজিয়ে মুকুল
ফুলে
আহ্লাদেতে হেলে
দুলে
চৌদিকে
নিকুঞ্জ-লতা নাচে মনোহর ।
সে আনন্দে
আনন্দিনী,
উথলিয়ে
মন্দাকিনী,
করি করি
কলধ্বনি বহে কুতূহলে !
-৩২-
এ ভুল প্রাণের
ভুল ,
মর্ম্মে বিজড়িত
মূল,
জীবনের
সঞ্জীবনী অমৃত-বল্লরী;
এ এক নেশার
ভুল,
অন্তরাত্মা
নিদ্রাকুল,
স্বপনে
বিচিত্ররূপা দেবী যোগেশ্বরী।
-৩৩-
কভু বরাভয় করে
,
চাঁদে যেন সুধা
ক্ষরে-
করেন মধুর
স্বরে অভয় প্রদান;
কখন গেরুয়া
পরা,
ভীষণ
ত্রিশূলধরা
পদ-ভরে কাঁপে ধরা, ভূধব অধীর;
পদ-ভরে কাঁপে ধরা, ভূধব অধীর;
দীপ্ত সূর্য্য
হূতাশন
ধ্বক ধ্বক
দু-নয়ন,
হুঙ্কারে বিদরে
ব্যোম,লুকায় মিহির;
ঘোরঘট্ট অট্ট
হাসি
ঝলকে পাবকরাশি
;
প্রলয় সাগরে
যেন উঠিছে তুফান!
-৩৪-
কভু আলুথালু
কেশে,
শ্মশানের
প্রান্ত দেশে
জ্যোস্নায় আছেন
বসি বিষন্ন বদনে;
গঙ্গার
তরঙ্গমালা
সমুখে করিছে
খেলা,
চাহিয়ে তাদের
পানে উদাস নয়নে !
-৩৫-
-৩৫-
পবন আকুল হয়ে
চিতা-ভস্ম-রজ
লয়ে
শোকভরে ধীরে
ধীরে শ্রীঅঙ্গে মাখায়;
শ্বেত করবীর
বেলা,
চামেলী মালতী
মেলা,
ছড়াইয়ে চারি
দিকে কাঁদিয়ে বেড়ায় !
-৩৬-
হায়! ফের
বিষাদিনী !
কে সাজালে
উদাসিনী ?
সম্বর, এ
মূর্ত্তি দেবী, সম্বর,সম্বর !
বটে এ
শ্মশান-মাঝে
এলোকেশী কালী
সাজে-
দানব-রুধির-রঙ্গে
নাচে ভয়ঙ্কর !
-৩৭-
আবার নয়নে জল!
ওই সেই হলাহল ,
ওরি তরে
জীর্ণজরা জীবন আমার !
গরজি গগন ভোরে
দাঁড়াও ত্রিশূল
ধোরে!
সংহার মূরতি
অতি মধুর তোমার !
-৩৮--
আমার এ
ব্রজ-বুক,
ত্রিশূলেরো
তীক্ষ্ণ মুখ,
দাও, দাও
বসাইয়ে, এড়াই যন্ত্রনা !
সম্মুখে
আরক্তমুখী,
মরণে পরম সুখী,
এ নহে প্রলয়
ধ্বনি, বাঁশরী-বাজনা!
-৩৯-
অনন্ত নিদ্রার
কোলে,
অনন্ত মোহের
ভোলে,
অনন্ত শয্যায়
গিয়ে করিব শয়ন;
আর আমি কাঁদিব
না,
আর আমি কাঁদিব
না,
নীরবে মিলিয়ে
যাবে সাধের স্বপন !
-৪০-
তপন-তর্পণ –আল
অসীম
যন্ত্রনা-জাল,
প্রশান্ত অনন্ত
ছায়া অন ন্ত যামিনী;
সে ছায়ে ঘুমাব
সুখে,
ব্রজ বাজিবে না
বুকে,
নিস্তব্ধ ঝটিকা
ঝঞ্ঝা, নীরব মেদিনী ।
-৪১-
বাঁধ বুক, ত্যজ
ভয়,
পুন্য এ, পাতক
নয়;
খুনে আর
পরিত্রাণে অনেক অন্তর ।
ভালবাসা তারি
ভাল,
সহে যারে চির
কাল;
বাঁচুক,বাঁচুক
তারা, হউক অমর!
৪২-
হবে না, হবে না
আর,
হয়ে গেছে যা
হবার,
ধোরো না,ধোরো
না,বৃথা রুধো না আমাকে !
এ পোড়া পিঞ্জর
পাখী,
উড়ূক
পরাণ-পাখি,
দেখুক,দেখুক,যদি
আর কিছু ত্থাকে !
ছাড় ! আন ! যাও
যাও
বেগে বুকে
বিঁধে দাও !
ওই সে ত্রিশূল
দোলে গগনমন্ডলে !
********************************
চতুর্থ সর্গ
----
গীতি
রাগিনী
ভৈরবী-তাল ঠা-ঠুংরী
কোথা গো
প্রকৃতি সতী সে রূপ তোমার !
যে রূপে নয়ন
ভুলাতে আমার !
সেই
সুরধুনী-কূলে
ফুলময় ফুলে
ফুলে,
বেড়াইতে বনবালা
পরি ফুলহার ।
নবীন-নীরদ-কোলে
সোনার যে দোলা
দোলে,
ক্ষণেক দুলিতে,
ক্ষণে পালাতে আবার !
সুধাংশুমন্ডলে
বসি
খেলিতে লইয়ে
শশী,
হাসিয়ে ছড়িয়ে
দিতে তারকাবতন;-
হাসি
দিগঙ্গনাগণে
ধরি ধরি সে
রতনে
খেলিতে
কন্দুক-খেলা,হাসিত সংসার।
এ তমান্ধ
তলাতলে
কি বিষম জ্বালা
জ্বলে,
কেবল জ্বলিয়ে
মরি ঘোচে না আঁধার।
চল, দেবী, লয়ে
চল,
যথা জাগে
হিমাচল,
উদার সে
রূপরাশি দেখি একবার ।
-------------
-১-
অসীম নীরদ নয়্
ওই গিরি হিমালয়
!
উথলে উঠেছে যেন
অনন্ত জলধি !
বোপে দিগ
দিগন্তর,
তরঙ্গিয়া
ঘোরতর,
প্লাবিয়া
গগনাঙ্গন জাগে নিরবধি !
-২-
বিশ্ব যেন ফেলে
পাছে-
কি এক দাঁড়ায়ে
আছে !
কি এক প্রকান্ড
কান্ড মহান ব্যাপার !
কি এক মহান মূর্তি,
কি এক মহান
স্ফূর্ত্তি,
মহান উদার
সৃষ্টি প্রকৃতি তোমার !
-৩-
পদে পৃথ্বী,
শিরে ব্যোম,
তুচ্ছ তারা
সূর্য্য সোম
নক্ষত্র,নখাগ্রে
যেন গণিবারে বারে;
সমুখে সাগরাম্বরা
ছড়িয়ে রয়েছে
ধরা,
কটাক্ষে কখন
যেন দেখিছে তাহারে !
-৪-
কত শত অভ্যুদয়,
কতই বিলয় লয়,
চক্ষের উপর যেন
ঘটে ক্ষণে ক্ষণে;
হরহর হরহর
সুর নয় থরথর
প্রলয় –পিনাক-
রাব বাজে না শ্রবণে!
-৫-
ঝটিকা দূরন্ত
মেয়ে,
বুকে খেলা করে
ধেয়ে,
ধরিত্রী
গ্রাসিয়া সিন্ধু লোটে পদতলে!
জ্বলন্ত-অনল-ছবি
ধ্বক ধ্বক
জ্বলে রবি,
কিরণ
জ্বলন-জ্বালা মালা শোভে গলে ।
-৬-
কালের ক রাল
হাসি
দলকে দামিনী
রাশি,
কক্কড় দন্তে
দন্তে ভীষণ ঘষণ;
ত্রিজগৎ
ত্রাহি ত্রাহি,
কিছুই
ভ্রূক্ষেপ নাহি,
কে যোগেন্দ্র
ব্যোমকেশ যোগে নিমগন !
-৭-
ওই মেরু উপহাসি
অনন্ত বরফ-রাশি
যবন তপন করে ঝক
ঝক করে!
উপরে বিচিত্র
রেখা,
চারু ইন্দ্রধনু
লেখা,
অলকা অমরাবতী
রয়েছে ভিতরে-
লুকান লুকান
যেন রয়েছে ভিতরে !
-৮-
ওই কিবে ধবধব
তুঙ্গ তুঙ্গ
শৃঙ্গ সব
ঊর্দ্ধমুখে
ধেয়ে গেছে ফুঁড়িয়া অম্বর !
দাঁড়াইয়ে
পাদদেশে
ললিত হরিত বেশে
নধর
নিকুঞ্জ-রাজি সাজে থরে-থর !
-৯-
সানু
আলিঙ্গিয়ে করে
শূন্যে
যেন বাজি করে
বপ্র-কেলি-কুতূহলে
মত্ত করিগণ;
নবীন
নীরদমালা
সঙ্গে
সঙ্গে করে খেলা
দশন
বিজলী ঝলা বিলসে কেমন!
-১০-
ওই
গণ্ডশৈল-শিরে
গুল্মরাজি
চিরে চিরে
বিকশে
গৈরিক-ঘটা ছটা রক্তময় !
তৃণ
তরু লতাজাল,
অপরূপ
লালে-লাল,
মেঘের
আড়ালে যেন অরুণ উদয় !
-১১-
কাছে
কাছে স্থানে স্থানে
নীচ-মুখ উচ-কানে
চরিয়া
বেড়ায় সব চমর চমরী,
সুচিকণ
শুভ্র কায়
মাছি
পিছলিয়া যায়,
অনিলে
চামর চন্দ্রিমা-লহরী !
-১২-
কিবে
ওই মনোহারী
দেবদারু
সারি সারি
দেদার
চলিয়া গেছে কাতারে কাতার!
দূর
দূর আলবালে,
কোলাকুলি
ডালে ডালে,
পাতার
মন্দির গাঁথা মাথায় সবার !
-১৩-
তলে
তৃণ লতা পাতা
সবুজ
বিছানা পাতা;
ছোট
ছোট কুঞ্জবন হেথায় হেথায়;
কেমন
পাকম ধরি,
কেকারব
করি করি,
ময়ূর
ময়ূরী সব নাচিয়া বেড়ায় !
-১৪-
মধ্যমে
ফোয়ারা ছোটে,
যেন
ধুমকেতু ওঠে,
ফরফর
তুপড়ি ফোটে, কেটে পড়ে ফুল;
কত
রকমের পাখা
কলরবে
ডাকি ডাকি
সঙ্গে
সঙ্গে ওঠে পড়ে, আহ্লাদে আকুল !
-১৫-
জলধারা
ঝরঝর,
সমীরণ
সরসর
চমকি
চরন্ত মৃগ চায় চারি দিকে;-
চমকি
আকাশময়
ফুটে
ওঠে কুবলয়,
চমকি
বিদ্যুল্লতা মিলায় নিমখে !
-১৬-
একি
স্থান অভিনব!
বিচিত্র
শিখর সব
চৌদিকে
দাঁড়ায়ে আছে ঘেরিয়ে আমায়;
গায়ে তরু লতা পাতা
থোলো থোলো ফুল
গাঁথা,
বরফের-হীরকের
টোপর মাথায় !
-১৭-
তলভূমি
সমুদয়
ফুলে
ফুলে ফুলময়,
শিরোপরে
লম্বমান মেঘের বিতান;
আকাশ
পড়েছে ঢাকা,
আর
নাহি যায় দেখা
তপনের
সুবর্ণের তরল নিশান ।
-১৮-
কেবল
বিজলী-মালা
বেড়ায়
করিয়ে খেলা;
কেন
গো, বিমানে আজি অমরী অমর!
তোমরা
কি সারদারে
দেখেছ,
এনেছ তারে
ভূষিতে
এ প্রকৃতির প্রাসাদ সুন্দর ?
-১৯-
হা
দেবী, কোথায় তুমি ?
শূণ্য
গিরি-ফুলভূমি !
কোথায়-কোথায়-হায়-সারদা-সারদা!
আর কেন
হাস্য মুখে
হানো
উগ্র ব্জ্র বুকে ?-
কি ঘোর
তামসী নিশি !- *****
-২০-
আহা
স্নিগ্ধ সমীরণ,
বুঝিলে
তুমি বেদন !
বুঝিল
না সুলোচনা সারদা আমার !
হা
মানিনী ! মানভরে
গেছ
কোন লোকান্তরে?-
বল,
দেব, বল বল, কুশল তাহার !
-২১-
অয়ি,
ফুলময়ী সতী
গিরি-ভূমি
ভাগ্যবতী !
অভাগার
তরে তব হয়নি সৃজন;
দেখা য
দি পাই তার,
দেখা
হবে পূর্ণব্বার;
হলেম তোমার কাছে বিদায়
এখন !
-২২-
ওই ওই
ভৃগুভূমে
আচ্ছন্ন
তুহিন ধূমে
রয়েছে
আকাশে মিশে অপরূপ স্থান !
আবছা
আবছা দেখা যায়
গুহা
গোমুখের প্রায়,
পাতাল
ভেদিয়ে তায় ধায় যেন বান !
-২৩-
ফেনিল
সলিলরাশি
বেগ-ভরে
পড়ে আসি,
চন্দ্রলোক
ভেঙে যেন পড়ে পৃথিবীতে;
সুধাংশু-প্রবাহ-পারা
শত শত
ধায় ধারা,
ঠিকরে
অসংখ্য তারা ছোটে চারি ভিতে !-
অসংখ্য
শীকর-শিলা ছোটে চারি ভিতে !
-২৪-
শৃঙ্গে
শৃঙ্গে ঠেকে ঠেকে,
লম্ফে
লম্ফে ঝেঁকে ঝেঁকে
জেলের
জালের মত হয়ে ছত্রাকার,
ঘুরিয়ে
ছড়িয়ে পড়ে;
ফেনার
আরশি পড়ে,
উড়েছে
মরাল যেন হাজার হাজার !
-২৫-
আবরিয়ে
কলেবর
ঝরিছে
সহস্র ঝর,
ভৃগুভূমি
মনোহর সেজেছে কেমন!
যেন
ভৈরবের গায়
আহ্লাদে
উথূলে ধায়
ফণা তুলে চুলবুলে ফণী
অগণন !
-২৬-
নেমে
নেমে ধারাগুলি,
করি
করি কোলাকুলি,
একবেনী
হয়ে হয়ে নদী বয়ে যায়;
ঝরঝর
কলকল
ঘোর
রাবে ভাঙে জল,
পশু-পক্ষী
কোলাহল করিয়ে বেড়ায় !
-২৭-
সিংহ
দুটি শুয়ে তটে
আনন
অবধি জটে,
মগন
রয়েছে যেন আপনার ধ্যানে;
আলসে
তুলিছে হাই,
কাকেও
দৃকপাত নাই,
গ্রীবাভঙ্গে
কদাচিৎ চায় নদী পানে
-২৮-
কিবে
ভৃগু-পাদমূলে
উথুলে
উথুলে দুলে
টলে
ঢলে চলেছেন দেবী সুরধুনী !
কবির,যোগীর
ধ্যান,
ভোলা
মহেশের প্রাণ,
ভারত-সুরভি
–গাভী,পতিত-পাবনী ।
পুন্যতোয়া
গিরিবালা,
জুড়াও
প্রাণের জ্বালা !
জুড়ায়
ত্রিতাপ জ্বালা- মা, তোমার জলে !
----------------
পঞ্চম সর্গ
----
গীতি
রাগিনী
বেহাগ-তাল কাওয়ালী
মধুর রজনী,
মধুর ধরনী,
মধুর চন্দ্রমা,
মধুর সমীর !
ভাগীরথী-বুকে
ভাসি ভাসি সুখে
চলে ফুলময়ী তরী
ধীর ধীর !
আলুথালু কেশ,
আলুথালু বেশ,
ঘুমায় কামিনী
রূপসী রুচির!
অপরূপ হাস
আননে বিকাশ,
অধরপল্লব অলপ
অধীর !
না জানি কেমন
দেখিছে স্বপন
মধুর-মধুর-মূরতি
মদির!
-------------
-১-
বেলা ঠিক
দ্বিপ্রহর,
দিনকর খরতর,
নিঝুম নীরব
সব-গিরি,তরু,লতা!
কপোতী সুদূর
বনে,
ঘুঘু-ঘু করুণ
স্বনে
কাঁদিয়ে বলিছে
যেন শোকের বারতা !
-২-
তৃষ্ণায় ফাটিছে
ছাতি,
জল খুঁজে পাতি
পাতি
বেড়ায় মহিষ-যুথ
চারি দিকে ফিরে ।
এলায়ে পড়িছে
গা,
লটপট করে পা,
ধুঁকিয়ে
হরিণচিহ্নগুলি চলে ধীরে ধীরে ।
-৩-
কিবে স্নিগ্ধ
দরশন,
তরুরাজি ঘন ঘন,
অতল পাতালপুরী
নিবিড় গহন !
যত দূর যায়
দেখা
ঢেলে আছে
উপত্যকা,
গভীর গম্ভীর
স্থির মেঘের মতন ।
-৪-
কায়াহীন মহা
ছায়া
বিশ্ব বিমোহিনী
মায়া
মেঘে শশী ঢাকা
রাকা-রঞ্জনী-রূপিনী ,
অসীম কানন-তল
ব্যেপে আছে
অবিরল ;
উপরে উজলে ভানু, ভূতলে যামিনী !
-৫-
ঘোর ঘোর সমুদয়,
কি এক রহস্যময়,
শান্তিময়,
তৃপ্তিময় ভুলায় নয়ন;
অনন্ত বরষাকালে
অনন্ত জলদজালে
লুকায়ে রেখেছে
যেন জ্বলন্ত তপন !
-৬-
পত্র-রন্ধ্র
ধরি ধরি
কিরণের ঝারা
ঝরি
মাণিক ছড়িয়ে
যেন পড়েছে কাননে,
চিকণ শাদ্ধল
দলে
দীপ দীপ কোরে
জ্বলে
তারকা ছড়ান যেন
বিমল গগনে !
-৭-
নভ-চুম্বী
শৃঙ্গবরে
ও কি দপ দপ করে
!
কুঞ্জে কুঞ্জে
দাবানল হইল আকূল !
তরু থেকে
তরুপরে,
বন হতে বনান্তরে
ছুটে, যেন ফুটে
ওঠে শিমূলের ফুল-
রাশি রাশি
শিমূলের ফুল !
-৮-
অচ্চিপুঞ্জ লক
লক
ভক ভক ধ্বক
ধ্বক,
দাউ দাউ, ধূধূ
ধূধূ, ধায় দশ দিকে;
ঝল্কা ঝল্কা হল্কা ছোটে,
বোঁবোঁ বোঁবোঁ
চর্ক্কি লোটে
মাতাল ছুটেছে
যেন মনে বেঠিকে !
-৯-
দেখিতে
দেখিতে দেখ
কেবল
অনল এক
এক
মাত্র মহাশিখা ওঠে নিরবধি ;
আগ্নেয়
শিখর পরে
যেন
ওঠে বেগ-ভরে
ভীষণ গগন-মুখী
আগুনের নদী
-১০-
দিগঙ্গনাগণ
যেন
আতঙ্কে
আড়ষ্ট হেন,
অটল
প্রশান্ত গিরি বিভ্রান্ত উদাস;
চতুর্দ্দিকে
লম্ফে ঝম্পে
মত্ত
যেন রনদম্ফে
তোলপাড়
কোরে ধায় দারুণ বাতাস-
উঃ !
কি আগুন মাখা দারুণ বাতাস !
-১১-
ত্রিলোক-তারিনী
গঙ্গে,
তরল
তরঙ্গে রঙ্গে
এ
বিচিত্র উপত্যকা আলো করি করি
চলেছ
মা মহোল্লাসে !
তোমারি
পুলিনে হাসে,
সুদূর
সে কলিকাতা আন্দন নগরী ।
-১২-
আহা,
স্নেহ-মাখা নাম,
আনন্দ-আনন্দ-ধাম,
প্রিয়
জন্মভূমি,। তুমি কোথায় এখন !
এ বিজন
গিরি দেশে
প্রকৃতি
প্রশান্ত বেশে
যতই
স্বান্তনা করে, কেঁদে উঠে মন-
কেন
মা, আমার তত কেঁদে ওঠে মন ;
-১৩-
হে
সারদে, দাও দেখা !
বাঁচিতে
পারিনে একা,
কাতর
হয়েছে প্রাণ, কাতর হৃদয়;
কি
বলেছি অভিমানে-
শুনো
না , শুনো না কানে,
বেদনা
দিও না প্রাণে বথার সময় !
-১৪-
অহ অহ
, ওহো ওহো ,
কি মহান
সমারোহ !
ঘোর-ঘটা
মহাছটা কেমন উদার !
নির্সগ
মহান মূর্ত্তি
চর্তুদ্দিকে
পায় স্ফূর্ত্তি,
চতুর্দ্দিকে
যেন মহা সমুদ্র অপার !
-১৫-
অনন্ত
তরঙ্গ মালা
করিতে
করিতে খেলা
কোথায়
চলিয়া গেছে,চলে না নজর;
দৃষ্টি
–পথ-প্রান্তভাগে
মায়ায়
মিশিয়া জাগে
উদার
পর্দাথরাজি সাজি থরে-থর ।
-১৬-
উদার-উদারতর
দাঁড়ায়ে
শিখর-পর
এই যে
হৃদয়-রানী ত্রিদিব সুষমা!
এ
নির্সগ রঙ্গভূমি ,
মনোরমা
নটী তুমি;
শোভার
সাগরে এক শোভা নিরুপমা !
-১৭-
আননে
বচন নাই,
নয়নে
পলক নাই,
কাণ
নাই মন নাই আমার কথায়;
মুখখানি
হাস-হাস
আলুথালু
বেশ বাস,
আলুথালু
কেশপাশ বাতাসে লুটায় !
-১৮-
না
জানি কি অভিনব
খুলিয়ে গিয়েছে
ভব
আজি ও বিহ্বল
মত্ত প্রফুল্ল নয়নে !
আদরিনী,পাগলিনী,
এ নহে
শশি-যামিনী;
ঘুমাইয়ে
একাকিনী কি দেখ স্বপনে ?
-১৯-
আহা কি
ফুটিল হাসি !
বড় আমি
ভালবাসি
ওই
হাসিমুখখানি প্রেয়সী তোমার ;
বিষাদের আবরণে
বিমুক্ত ও চন্দ্রাননে
দেখিবার আশা আর
ছিল না আমার।
দরিদ্র
ইন্দ্রত্ব-লাভে
কতটুকু সুখ
পাবে?
আমার সুখের
সিন্ধু অনন্ত উদার;-
কবির সুখের
সিন্ধু অনন্ত উদার !
-২০-
ও
বিধূ-বদন-হাসি
গোলাপ
কুসুম-রাশি,
ফুটে
আছে যে জনার নেশার নয়নে;
সে যেন
কি হয়ে যায়,
সে যেন
কি নিধি পায়,
বিহ্বল
পাগল প্রায়,
বেড়ায়
কি বোকে বোকে আপনার মনে;
এস
বোন,এস ভাই,
হেসে-খেলে
চলে যাই
আনন্দে
আনন্দ করি আনন্দ-কাননে !
এমন
আনন্দ আর নাই ত্রিভুবনে !
-২১-
এমন
আনন্দ আর নাই ত্রিভুবনে ;
হে
প্রশান্ত গিরি-ভূমি,
জীবন
জুড়ালে তুমি
জীবন্ত
করিয়ে মম জীবনে ধন !
এমন
আনন্দ আর নাই ত্রিভূবনে !
-২২-
প্রিয়ে
সঞ্জীবনী লতা,
কত যে
পেয়েছি ব্যথা
হেরে
সে বিষাদময়ী মূরতি তোমার !
হেরে
কত দুঃস্বপন
পাগল
হয়েছে মন,
কতই
কেঁদেছি আমি কোরে হাহাকার !
-২৩-
আজি সে
সকলি মম
মায়ার
লহরী সম
আনন্দ-সাগর
–মাঝে খেলিয়া বেড়ায় ।
দাঁড়াও
হৃদয়েশ্বরী,
ত্রিভূবন
আলো করি,
দুনয়ন
ভরি ভরি দেখিব তোমায় !
-২৪-
দেখিয়ে
মেটে না সাধ,
কি
জানি কি আছে স্বাদ,
কি
জানি কি মাখা আছে ও শুভ আননে !
কি এক
বিমল ভাতি,
প্রভাত
করেছে রাতি;
হাসিছে
অমরাবতী নয়ন-কিরণে !
-২৫-
এমন
সাধের ধনে
প্রতিবাদী
জনে জনে,
দয়া
মায়া নাই মনে, কেমন কঠোর ।
আদরে গেঁথেছে
বালা
হৃদয়-কুসুম-মালা,
কৃপাণে কাটিবে
কে রে সেই ফুলডোর !
-২৬-
পুন
কেন অশ্রুজল,
বহ
তুমি অবিরল!
চরণ-কমল
আহা ধুয়াও দেবীর !
মানস-সরসী-কোলে
সোনার
নলিনী দোলে,
আনিয়ে
পরাও গলে সমীর সুধীর !
বিহঙ্গম
, খুলে প্রাণ
ধর রে
পঞ্চম তান !
সারদা-মঙ্গল-গান
গাও কুতুহলে !
******************
।।শান্তি ।।
রাগিনী
সিন্ধু ভৈরবী- তাল ঠুংরি
প্রিয়ে,
কি মধুর মনোহর মূরতি তোমার !
সদা
যেন হাসিতেছে আলয় আমার !
সদা
যেন ঘরে ঘরে
কমলা
বিরাজ করে,
ঘরে
ঘরে দেব-বীণা বাজে সারদার !
ধাইয়ে হরষ-তরে
কল কোলাহল করে,
হাসে খেলে
চারিদিকে কুমারী কুমার !
হয়ে কত জ্বালাতন
করি অন্ন আহরণ,
ঘরে এলে উলে
যায় হৃদয়ের ভাত!
মরুময় ধরাতল,
তুমি শুভ শতদল,
করিতেছে ঢলঢল
সমুখে আমার !
ক্ষুধা তৃষ্ণা
দূরে রাখি,
ভোর হয়ে বসে
থাকি,
নয়ন পরাণ ভোরে
দেখি অনিবার !-
তোমায়, দেখি
অনিবার,
তুমি লক্ষী
সরস্বতী,
আমি
ব্রহ্মান্ডের পতি,
হোগ গে এ
বসুমতী যার খুসী তার !
******************
।।সম্পূর্ণ
।।