...অনন্য রায়.......(১৯৫৫-১৯৯০)..
(কাব্যগ্রন্থ- দৃষ্টি অনুভূতি ইত্যাকার প্রবাহ এবং আরো কিছু, নৈশ বিজ্ঞপ্তি, আমিষ রুপকথা, চুল্লীর প্রহর, নীল ব্যালেরিনা...কাব্যনাট্য-আলোর অপেরা)
পিপের মধ্যে ঘুমিয়ে ছিলো প্রজাতির মহাভারত। বিচ্ছু ছেলেটি লাথি মারতেই তাকে,- উল্টে পড়ে গড়াতে লাগলো প্রত্ন সাম্প্রতিক অবচেতনের নিস্ফল চত্বরে ; আর তখনই ঘটলো স্বপ্নের মধ্যে গন্ধকের লাল ক্রিসেন্থিমামের বাস্তব বিস্ফোরন !
১৯৮৯ এ অনন্য রায়ের কাব্যনাট্য ‘আলোর অপেরা’ শুরু হচ্ছে এভাবেই। চেতন অবচেতনের গর্ভে ঘুমিয়ে থাকা লাজুক সন্ধিবয়সের ববিনে এভাবেই জড়িয়ে গেল অনন্যের কোহল সংহিতা। কবিতার সারফেস রিয়েলিটির থেকে নির্গমন আর স্নায়ুকোষে লেগে থাকা মাংসের প্রতিভার অনন্য নির্মিতিতেই বোধহয় কবি অনন্য রায় কোনো স্বাগত অভিশাপ থেকে বলে উঠলেন- “I’m tired of being a Non-being” আর রহস্যের লিপি ঘিরে পেরিয়ে গেলেন চিলড অমরতা!
সেই শৈশবে, আলোর অপেরা পড়তে গিয়ে বার বার থেমে যেতাম সকরুন ক্ষুধার সরাইখানায়। মানুষ বলতে ভিবজিওয়ের নিয়মে মাত্র ছজন। সারা পৃথিবী আচ্ছন্ন পারমানবিক হলোকস্টের কালো তেজস্ক্রিয় হিম বৃষ্টিপাতে। শুধু সবুজ রংটাই অবলুপ্ত; কেননা মৃত্যুর গায়ের মাংস সবুজ এবং চোখ দুটো কালো জামের!....এমনই এক নিঃসঙ্গ শর্বরীতে , বরফে ঢাকা ইগলুর ভেতর বসে আছে চারজন পুরুষ ঃ- অর্ণব, অবনী, শিলাদিত্য এবং ঋত্বিক । আর দুজন রমনী ঃ- রুপানন্দা ও লোপামুদ্রা। আর তাদেরই আত্মকেন্দ্রিক, অসংলগ্ন, তর্কপরায়ন এলোমেলো এবং পরস্পর-সম্পর্কবিহীন কথাবার্তা শুনছে মৃত্যুর ওপার থেকে হয়তো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে, বারো বছরের এক বিচ্ছু বালক...’অনন্য’.....
সত্তর আশির কবিতার নিগূঢ পর্যটক কবি তুষার চৌধুরীর সহৃদয় বন্ধু ছিলেন অনন্য। অনন্য রায়ের কবিতা পড়তে পড়তে কোথাও তুষার চৌধুরীরই কিছু অন্তর্বতী পংক্তি মনে পড়ে যায়- ‘ বইয়ের ভেতরে থ্যাতলানো প্রজাপতির মতো/ স্বপ্নহীন আমি/ বালুচরে কাঁকড়াদের হেঁটে চলায়/ লেখা হয়েছে আমার কবিতা...’
এত অল্প পরিসরে অনন্য রায়ের মত কবির মূল্যায়ন সত্যিই অসম্ভব তবু দূরে কোথাও কোনে বসে কেউ পিয়ানো-আর্কেডিয়ানে একদা জনপ্রিয় ‘লা পালামো’র সুর বাজাক আর প্রজন্ম ও মৃত্যুর মাঝে বসে আমরাও দেখে নিই কালো জলে ভেসে যাওয়া অনন্যের প্রকাণ্ড ঠাট্টা...
( আলোর অপেরা ) ||১৭||
দিগন্তের সবুজ চাঁদ নিচু হয়ে চুমু খেলো
ধানক্ষেতের অবলুপ্ত ঠোঁটে;
গম্বুজের সৌগন্ধ বুকে বয়ে চলে নদী
ঝরাপাতার অবিরাম শব্দে আচ্ছন্ন করে নিজেকে।
সিল্কমসৃন স্বপ্নের দাঁতগুলো ক্রমশ তামাটে হয়।
আমার করতল থেকে জন্ম নিয়ে প্রজাপতি এবং ছাই
সেই বিশাল হাঁ-মুখে , অজানার গর্তে, লুকিয়ে যায়
অন্ধকারে- স্তব্ধতার অবয়বে।
জলপাই-অরন্যের প্রগাঢ স্তব্ধতা,
একট লম্বাটে ভাঙা মদের বোতল ও নিঃসঙ্গ গীটার,
কিছু নরখাদক নথিপত্র এবং ইস্পাত
সহসা ক্যাক্টাসের ঝড়ে উঠলো কেঁপে;
যখন জ্যামিতিক আয়নার চারপাশে
একঝাঁক পায়রা গেলো আচ্ছন্ন মেঘের মতো উড়ে ।
ঘুমোও অনন্য ! ঘুমোও ; কেননা রাত্রি বড়ো দীর্ঘস্থায়ী-
যতক্ষন-না তোমার ঘুম কমলালেবুর মতো হয়ে যায়
এবং কবরের ঘাসের মতো তোমার স্বপ্নগুলো চাঁদের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়
এবং তোমার ঠোঁটের ওপর শ্যাওলা জমে,-
ঘুমোও তুমি, অবগুন্ঠিত বিস্মৃতির মতো,
যেখান দিয়ে লাক্সনপ্রাচীর ছুটে গেছে চূর্নবিচূর্ণ দ্রুতব্রম্ভান্ডের দিকে....
আর পরিদৃশ্যমান তোমার ব্রোঞ্জের বিশাল বিস্মৃতি
শ্বেতপাথরের খিলানের মতো তোমাকে করে দিক দীর্ঘ গোলাকার।
হাওয়া এখন তার পিচ্ছিল সবুজ আর্দ্র স্মৃতিচারনায়
মুড়ে রাখবে আমাকে
আর মূর্হূতের পর মূর্হূত- অনন্তকাল
অরেঞ্জ কার্পেটের ওপর পড়ে থাকবে আধখানা মৃত্যুভক্ষ্য রক্তিম আপেল!
( আলোর অপেরা ) ||১৮||
আবহমান রেললাইনের অন্ধসড়কে, বাগীশ্বরী ধূলোর মাতৃক্রোড়ে, পড়ে
রয়েছে অসনাক্ত একটা মুন্ডুহীন লাশ ; এবং তাকে উবু হয়ে বসে গভীরভাবে
তদন্ত করছে একটা ন্যাংটো কচি বাচ্চা ।
ঘড়ির শব্দ।
লাশটার কবন্ধ ক্ষতস্থানে থকথক করছে রক্ত....
ঘড়ির শব্দ।
একটি কচি আঙুল সেই ক্ষতমুখের গর্তে প্রবেশ করে...
ঘড়ির শব্দ।
বাচ্চাটা জিভে আঙুল ঠেকিয়ে সেই রক্তের স্বাদ চাখে এবং বোকার মতো
ফ্যালফ্যাল করে পাঠকের দিকে তাকিয়ে অল্প হাসে।
বাচ্চা এবং লাশটার ওপর দিয়ে ভোরের হু হু অগ্নিবর্ণ তেজস্কিয় হাওয়া
বইতে থাকে ; যেন প্রেতের চিৎকার।
শুধু ঝরাপাতার ওড়াউড়ি ।।
( আলোর অপেরা ) ||১৯||
শব ব্যবচ্ছেদ করো : অন্ধ-বালিকার থার্মোমিটারের গর্ত দিয়ে
দ্যাখা নীল জ্বর
আত্মমেহনের শাদা কুমারীর ছেঁড়া চোংতন্তু, কাটা স্তন, উরু,
উড়ন্ত নিতম্ব, পরিচ্ছদ
কারা প্ররোচিত করে কঙ্কালের রনলিপ্সা, নারকীয় আত্মহত্যা,
বারাসত-বরাহনগর
বোবা ভ্রুন, ঠ্যাংবিম্ব : ভাঙা সাম্রাজ্যের কামজ্বরে মুগ্ধ হীরের সুন্নত!
শব ব্যবচ্ছেদ করো : মকরকোষের আঁশ ; দ্রুত ম্যাডোনার মূর্তি
গেয়ে ওঠে নক্ষত্রের শিঙা
ভাঙা করোটির নীল ক্ষুদে-ক্ষুদে শিঙার গোঙানি
কঙ্কালের ডানা ছেঁড়ে উড়ন্ত পরীর সেলুলোজ ছেঁড়ে সেঁউতির
দেবদূত, অন্ধ ডিঙা
চাঁদের চকচকে রুপোরশ্মি জ্বলে সমুদ্রের ঢেউয়ে ; আমি
সেটুকু করেছি রাহাজানি।.......( আংশিক )
( আলোর অপেরা ) ||২১||
নিস্পলক বসে থাকা : কফি ও টোস্টের বিবমিষা ;
নীল কাপড়ের স্তুপ ছড়িয়ে পড়েছে এলোমেলো ;
মেঘের মেখলাপড়া বিষাদ-আরুঢা মোনালিসা
সহসা, দূরত্বমুগ্ধ, নিঃসঙ্গ আপেল কামড়ে খেলো ;
সারাদিন সারারাত এই মৃত্যুযাপনের চিহ্ন আঁকাবাঁকা
নৈঃসঙ্গ্য উতকীর্ণ করে উভয়ের শিলীভূত ভাস্কর্যভঙ্গিমা : ভাঙা সাঁকো ;
নীল কাপড়ের স্তুপ মেঘ মোনালিসা এলোমেলো বেঁচে থাকা
স্তব্ধতা বুনন করে বিবাহের ভাঁজে-ভাঁজে ভস্মশেষ : নিস্ফল টোব্যাকো !
( আলোর অপেরা ) ||৫৩||
নাভির গভীরে ছিল ৫৮ উনুন
প্লাস-মাইনাসের জিহ্বা ঈশ্বরের লেহনভঙ্গিমা ৪০৭
২ নারী ৬ কুমার ১২ পাখি সাদা কালো তন্তুসমুদ্রের অন্ধনুন
৪৩ বাতিদান ; নক্ষত্রশিকড়ময় নতুন পাতার গন্ধ;
বজ্রের ডালপালা; সাদা হাত
অরণ্যের খাঁ খাঁ স্বর ; ৮৫ উইলোবন ; ৯৭৪ ধূলোবালি
১৯৮-সংলগ্ন গির্জাচূড়া ; কালো কাল ; ম্লান কন্টিকারি
জড়িয়ে রেখেছে ৫২৭ বল্কলে ; ইব ঈশ্বর-মাকড়সা ঊর্দ্ধবাহু
৮৪৯ ম্যাজিশিয়ান ; আলখাল্ল ; মর-অ্যাকিলিস ৯০ গোড়ালি
৪৭৩ নীল মেঘ থেকে ঝরে পড়ে শারীরিক বিভাজন, উড়ন্ত ক্যানারি
সংখ্যার ক্যাওড়ামি থেকে ঈশ্বর অনন্তবিন্দু, করোটির রাহু।
কিমিতি-বাওয়াল থেকে উঠে আসে মায়াবলোকন ; লোর্কা ;
কস্তুরীর বিষ;
ঈশ্বর বিমূর্ত জ্রেবাভাবনার কেন্দ্রবিন্দু , ৭৩৯ গোলাপী ঘা
১৯ ছাতার নিচে তেতো পেট্রোডলারের বিষাদপ্রতিমা
অর্হনিশ
ঈশ্বর শ্বাশত শূন্য- ৭৯৪ নিয়তি ছড়ায় ক্লিববম্ভ্রার কুয়াশা।।
দিনযাপন....
প্রতিটি মূর্হুত হয়ে উঠুক নতুন পাতার মতো সবুজ সতেজ
এবং মৃত্যুর মতন ভয়ঙ্কর।
কবিত্ব-ফবিত্ব আমার নেই
শুধু চাবুক আর চাবুক আর চীৎকার-
ইলেট্রিক ইঞ্জিনের সশব্দ অন্ধকারের উড়োনচণ্ডি চমকে
মসৃণ চাদরে ঢেকে রেখেছে আমায়
কাকতাডুয়ার মতো বেমক্কা নির্জন রাত্রি,
আর সামনে ঝুলছে জায়মান অতীত
বরফের লিকলিকে হিম সাপের মতো,
চীনাবাদামের নৈঃশব্দ্যের মতো।
এই টানাপোড়েন আর ভালো লাগে না
কী অসহ্য এই পোড়া মাংস, এই মৃত্যু, এই মদ,
নারীর শরীরময় আনন্দের জঘন্য সন্ত্রাস।
আজীবন রুটির ধান্দায় কলে কারখানায় বন-বাদাড়ে ঘুরে
তোমাদের ফিরিয়ে দিতে একতাল মাংসল ভালোবাসা
জবুথবুর মতো বিছানায় শুয়ে ঝড়ের স্বপ্ন দেখতে ভালো লাগে না আর
এই টানাপোড়েন আর ভালো লাগে না।
এখন স্বেদারু আর কাঁচপোকার স্তব্ধতাকে চিরে ফ্যালে
অদ্বৈতাচারী চাবুকের পর্যুদস্ত হিসহিসে বিদ্যুৎ,
ডিমের খোলশের মধ্যে মৃত্যু পেয়েছে নির্বাক বিছানা
চতুর্দিকে ঘিরে ধরেছে পুলিশের মতো সশস্ত্র নিয়তি
কালো দেয়ালের বিমূঢ কঠিন পরিহাসে।
ঋত্বিক ঘটকের ছবির মতো বিপন্নতা বুঝি কাটিয়ে এলাম
কাটিয়ে এলাম অজস্র টানাপোড়েন আর শীতরাতের হিম নিঃসঙ্গতা
প্রতিটি মূর্হুত ফেটে জন্ম নিচ্ছে এখন নৃমুণ্ডের উজ্জ্বল বিস্তৃত আকাশ,
আর পচা শ্যাওলার মতো সবুজ নতুন পাতায়-পাতায়
কাঠবিড়ালীর মতো মেঘ কেটে ছুটছে চাঁদ লাফিয়ে লাফিয়ে-
নিয়তির কালো পুলিশের সশস্ত্র কঠিন পরিহাসে।
টারান্টেলো...
আমি কলঙ্কিত করবো নম্র শাদা কাগজের কুমারী স্তব্ধতা;
অস্তির শিশিরবিন্দু মুঠো করে মিশে যাবে ঘাসে;
আক্রোশে সৃজন করবো শব-ব্যবসায়ী এক ছন্দের দেবতা
গ্রন্থের কুয়াশা ছিঁড়ে জ্বলে উঠবো বজ্রমেহ ঊর্ণার আকাশে;
আমার শরীরী মেধা স্বপ্নহত্যা জ্বলে উঠবে প্রজাতির ঢেউয়ের চুল্লিতে
মাংসের বন্দীত্ব বস্ত্র-পরিহার করে যাব হরফের ব্যক্তিগত স্নানে;
ইভনিং পুরোকায়স্থের সঙ্গে প্রতি শনিবার যাব মৃত্যুনীল নিষিদ্ধ-পল্লীতে;
নেহাৎ ছলনাবশে আত্মহত্যা করতে যাব সব পেয়েছির ইস্টিশানে
কুমারীর গর্ভকোষে; এভাবে অভ্যাসমুগ্ধ মৃত্যুযাপনের থেকে চাই রুপান্তর;
আমার যা-কিছু নেই তারই জন্যে মোহগ্রস্ত আমি পূজো করবো প্রিয়
অজানার ক্ষত;
অক্ষরের মেঘাবৃত সৌরউরসের ঘুমে উঁকি মারবে অনন্য ঈশ্বর-
বাথটাবে ফেনার মধ্যে স্নানরত মাকড়শার মতো!
চিংড়িমাছ-
জলের প্রেমিক তুমি, চিংড়িমাছ, জলের অতলে নর্তকীর
মতো তুমি জাপানী ফ্লাওয়ার ভাসে চীনা মৃৎশিল্পীর চিত্রার্পিত
দুটি শূঁড় কথা বলে জলগর্ভে শৃঙ্খলের সঙ্গে নিয়তির
অশ্রুত সংলাপ, তুমি এঞ্জিনের মৃত্যুশব্দে প্রলুব্ধ, বিস্মিত।
জলের প্রেমিক তুমি, তবু যেন ঈডিপাস, জলের সন্তান, ঝিকিমিকি
কালের ঘণ্টার মতো ঢেউয়ে-ঢেউয়ে অবিরাম নাচ এলোমেলো
যখন জালের মধ্যে ধৃত তুমি, অসহায়, একান্ত প্রতীকী
মূঢ আত্মহননে চুম্বনে যেন সশস্ত্র ওথেলো।
২৭৪৮--
মনে করো ; দু-হাজার সাতশো আটচল্লিশ সনে আমি গুহামানবের দেঁতো
নিশ্চেতনে
আবার এসেছি ফিরে লাল কৃষ্ণচূড়া ছিঁড়ে নক্ষত্র রকেটে ছুটে কোয়ান্টাম
শান্তিনিকেতনে
শিশুরা সহাস্যে বলবেঃ ‘কেমন লাগছে এই পৃথিবীর ইস্পাতের ঘাসে
ভেসে যেতে-
তোমাদের কালে নাকি ছিলো ‘মৃত্যু’ আমে এক ফুটো পাশবালিশ? ছিলো
‘হিরোশিমা’ নামে এই মার্বেল খেলার ক্ষুদে পিল?
আমি হতবাক হয়ে চেয়ে দেখি ; উদ্ভিদের কথা বলছে সুইডিশ ভাষায় আর
কোষপ্রযুক্তিশাস্ত্রের রভসে ঝিলমিল
সাঙ্গীতিক হাই তুলছে মঙ্গলের নরনারী ; বৃহস্পতি-রোবোটেরা চেখে দেখছে
শ্রমের অর্কেষ্ট্রা ! তাইঃ ‘কী রকম ভালো লাগবে খেতে
কালের ক্যাপসুল গিলে জেনে নিতে ভূত-ভবিষ্যত ?’ আমি ভাবি,
আর তখনই শিশুরা
আমাকে প্রেজেন্ট করে কুটকুটে আপেল এক ; যাতে লেখা আছেঃ
‘নাং-বিংশশতকের উপদাংশ-কারাগার !’
আমি সেই তেজস্ক্রিয় আপেলে কামড় দিয়ে দেখিঃ নদীমাতৃক বাংলার স্রোতে
দাঁড় টানে পন্যচারী মৃত্যুর পরস্ত্রী-অন্ধকারঃ
এ-স্পর্শবিভ্রমে আমি মাথা রাখি সঙ্গিনীর আধেক বালিশে ; আর সে আমার
ঠোঁটে ছোঁড়ে বজ্রদন্তী-চুম্বনের স্বপ্নের ধুতুরা!
কে জানে আবার কবে দ্যাখা দেবে জাগরনে দু-হাজার সাতশো আটচল্লিশ সেই
বিছানায় লাল কৃষ্ণচূড়া-
সারাদিন সারারাত আমি অপেক্ষায় আছি তার ।
ভেরোনিকা...
যে কোন রহস্যঘন ধ্বনিঃ তার নাম ভেরোনিকাঃ
ভেরোনিকা, ভাঙা ঢেউ চূর্ন করে গেরস্থপ্রপাত
মাংসের অনন্য সংজ্ঞা না-নির্ণয় করে, আমি যেই
স্পর্শ করি বর্ণমালা, অন্ধ ঢেউ, শর্করার দাঁত
দেখি আক্রোশের শাদা ফেনা ছাড়া আর কিছু নেই
আমিষ মকরগর্ভে নিস্ফল উপলজন্ম, নীল কান্না, মর-প্রহেলিকা ;
জ্বলন্ত ঝিনুক ভাসে সংকেতের স্রোতেঃ তার নাম ভেরোনিকা !
অপ্রাপ্তবয়স্ক...
যদি ফিরে আসে সেই ভ্যানিলার গন্ধমাখা কুহেলি বালকবেলা; ছেদো হরিদ্রাভ
চাই না ফেরত তাকে; মহাকাল ! যা নিয়েছো; নাও;
আমি কেবলি ভবিষ্যে ভেসে যাব।
উনিশশো পঞ্চান্ন ! আর কখনো আসবে না, বলো, কথা দাও ; স্ফীত গর্ভমেঘ
কখনো আসবে না আর, কথা দাও, বৃথা জন্ম ; কলকাতায় নিকিতা ক্রুশ্চেভ!
কী নিস্ফল ঘনঘটা ! স্টূপিড-জন্মের মৃত্যুকাম !
( যেভাবে সাতাশে এসে সহসা জেনেছি আমি শৌখীন তুখোড় আলট্রা-বাম !)
তেমনি কি মনে পড়ে আমার জন্মের হর্ষে দাদুর গলায় কোনো
শ্লেষ্মা ছিল কি না?
জেব্রা-ক্রশিঙের দিকে তখনো যেতো কি দৌড়ে কামাতুর অন্ধ
তার হাতছড়ি-বিনা?
কিছুই পড়ে না মনে ; আমি শুধু ক্যালেণ্ডারের সংখ্যার শৃঙ্খলা হয়ে
লেপ্টে যেতে থাকি;
(অন্ধ আফ্রিকার দিকে তারো আগে উড়ে যায় সূর্যমূখী ক্ষুধাতুর লুমুম্বার পাখি!)
এভাবে ক্রমশঃ আমি বড়ো হতে থাকি নরখাদক-ঐতিহ্যে।
ঘোষাল স্ট্রীটের এঁটো গলি দিয়ে হেঁটে যায় ফিরিঅলা, কচি কবি,
বিখ্যাত মেয়র, দিশী হিজড়ে
সকলেই গাল টেপে ; কেউ বলে; ‘ব্যাটা হবে রবিঠাকুরের মতো সম্ভ্রান্ত কাবাব !’
এভাবে ক্ষয়িত হয় নেকা-বোকার-পরা দিনগত অভ্যাসের পাপ।
তারপর যখনই আমি সূর্যের ঝরোকা দিয়ে তাকিয়ে দেখেছি বাইরে-
অ্যানথ্রপো-বিকেলে;
দেখেছি ফুটপাতে শুধু রক্তাক্ত শ্রমের ছকে স্বপ্ন আর মৃত্যু স্পর্শাতুর দাবা খেলে।
ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে জামিরের বন থেকে সুইনহো স্ট্রীটের এঁদো গর্ত ;
হতস্পন্দে রর্জাস রোগ, চন্দ্রশেখরের গুগলি, প্রাত্যহিক হাঁপানির
হলদে নাভিশ্বাস-ওঠা মৃত্যুর ছেনাল মায়ামর্ত্যে
কখনো পাইনি খোঁজ অস্তিজিজ্ঞাসার এক হোমিওপ্যাথিক ওষধির।
রক্তমাখা পুলিশ, নাপিত, বেশ্যা, পৌরস্থপতির ছেলেপুলেদের হেঁজিপেঁজি ভিড়
সঙ্ঘ-সোলারিস থেকে আমার নিভৃত স্বপ্নে ছুঁড়ে মারে আলোর বুলেট!
ইতিমধ্যে পার্টি-ভাগ, বাবা ও মায়ের ঝগড়া, রুশ চীন বির্তকের নোনতা ওমলেট ;
কিম্বা মনে পড়ে সেই পাড়াতুতো জ্যাঠামনি, যে আমাকে স্বতোঃপ্রনোদিত কাছে ডেকে
আমার উপাস্য কণ্ঠে রবীন্দ্র সংঙ্গীত শুনে বলেছিলো;
‘ এমন বখাটে গান শিখলে কোত্থেকে?’
লোকরি কবিতা পড়া, স্কুলবালিকার স্ফুটস্তনে হাত, অথবা ইডেনে-দ্যাখা
রোহন কানহাই
( ব্লু রিবাণ্ড অমরত্ব না পেলে কী ক্ষতি করবে ক্ষনিকের স্ফূর্তির চোলাই?)
এসবের থেকে ক্রমে দূর সরে এসে আমি কখনো খুঁজিনি পরপারে আদিপিতা;
অথবা চাইনি লিখতে চেরী-ব্লসমের মতো চকচকে কবিতা।
এভাবে বছর ঘোরে ; অচিকিৎসা শ্রান্তির রভসে।
রক্তপাতে ভেসে যায় সমুত্থিত বাংলার প্রান্তর ; আমি ঘাপটি মেরে
ঘরে থাকি বসে !
দাদার নকশালপন্থাঃ বারাসতে হাত পা বাঁধা আটজনের লাশ ;
( তারা তো আমার কেউ নয়; আমি ঈশ্বরের স্বপ্নদোষে
চমৎকার রয়েছি ! সাবাশ ! )
চোখ বুঝে অতঃপর পরিচারিকার সঙ্গে ( শ্রেনীসমন্বয় হেতু) করেছি সঙ্গম
তুষারের সঙ্গে ঘোরা বেশ্যাপল্লী , ম্যানড্রেক্স , সাপের ছোবল , কিম্বা
কর্ক তোর মহার্ঘ্য ‘অর্ফিউস’ দেখে মৃত্যুর ক্ষুধার উপশম
করেছি, সঞ্জয় , পিন্টু এসে জানিয়েছে ঘৃনা বাহাত্তুরে নির্বাচনে রাম-কুপোকাৎ
মৃত্যুর ওপার থেকে ‘চলে এসো’ বলে হাতছানি দ্যায় দিব্যযোনি স্বাস্থ্যের জল্লাদ-
(প্রিয়দর্শিনী সেই ককতোর নায়িকা নাকি?)..... আমি তার
আর্দশ স্তব্ধতায় ভেসে যাই ;
আমার সুস্বাদু মাংস ইচ্ছা চিন্তা বাস্তবতা কেটে কিমা করে শ্রান্ত স্বপ্নের কসাই !
বিকলাঙ্গ স্পৃহা নিয়ে অনেক উড়েছি আমি বারদুয়ারী বের্লিন নিউ আলির্ন্স থেকে
খালাসিটোলায় ;
পৃথিবী গিয়েছে ভরে টোকো মদ, নৌ বহর, শালপাতা, শম্ভু মিত, লঙ্কা ও ছোলায় ;
ইয়াঙ্কিদের ভিয়েৎকং-হত্যার বিপক্ষে আমি কখনো করিনি প্রতিবাদ;
জুজু-সঞ্জয়ের ভয়ে বোধিদ্রুমের নিচে পাৎলুনে প্রস্রাবরত লক্ষ করি রক্তমাখা
কোজাগরী চাঁদ !
( উভলিঙ্গ-স্কুল ছেড়ে যখন পাকড়েছি পুরুষকার-পদ্য ; তখন বয়েস প্রায়
বালখিল্য-ষোলো !
বাথরুমে আরশোলা হত্যা করে ক্ষিপ্ত কল্পনা করেছি বুঝি এ দেশে উর্বর
কৃষিবিপ্লব সংগঠিত হলো!)
কী লিখেছি সারাবেলা ; না-কবিতা, না-প্রবন্ধ, গল্প বা সঙ্গীত, ছবিও না !
বিশুদ্ধ কবিতাপন্থী সমালোচকের দল আমাকে দেখেই তাই
লিখে রাখে আগেভাগেঃ ‘এখানে পিসাব করিও না !’
তবুও চৌচির ছাড়া, নিজেকে নস্যাৎ ছাড়া, নিয়মতান্ত্রিক কোনো
ধিক্কার জানি না ;
প্রাপ্তবয়স্কের কোনো নস্ট্যালজিয়া নেই ; আছে ভবিষ্যতঃ রক্তমাংস-বিনা!
এই তুচ্ছ বেঁচে থাকাঃ অপ্রাপ্তবয়স্ক ঠাট্টা- একে আমি
আষ্টেপৃষ্ঠে সাপটে ঘেন্না করি ;
তবু এই বেঁচে থাকাঃ এই বেঁচে থাকাটুকু একমাত্র সুন্দরঃ সত্য ;
সাক্ষী থাকে মৃত্যুর প্রহরী!